শুক্রবার, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ত্রি-পাক্ষিক বৈঠকে চীন, ইরান এবং রাশিয়া একযোগে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে নিজেদের সহযোগিতার পরিধি প্রসারিত করার জন্য আলোচনা করেছে। বৈঠকে তিনটি দেশের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সম্মত হন যে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করা এবং একে অপরকে সহায়তা প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
বৈঠকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:
এই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চীন, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে যৌথ সহযোগিতা বাড়ানো, বিশেষত শক্তি, প্রযুক্তি, এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে। বৈঠকটির মধ্যে এই তিনটি দেশ তাদের আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংযোগকে আরো শক্তিশালী করার জন্য নতুন পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য এবং সাম্প্রতিক আঞ্চলিক সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে চীনের কৌশলগত সম্পর্ক:
চীন দীর্ঘ সময় ধরেই ইরান এবং রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। রাশিয়ার সঙ্গে চীন বিশেষভাবে শক্তি খাতে সহযোগিতা করছে, বিশেষত গ্যাস এবং তেলের ক্ষেত্রে। ইরানও চীনের সাথে তার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে আগ্রহী। চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” (BRI) প্রকল্পে ইরান এবং রাশিয়ার অংশগ্রহণ সম্পর্কগুলিকে আরও গভীর করেছে।
ইউক্রেন সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি:
এই বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গে। চীন এবং রাশিয়া, যা ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে, তারা এই ব্যাপারে একে অপরকে সমর্থন জানিয়েছে। চীন ইউক্রেন সংকটে একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে চায় এবং সেই সঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলির বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়। রাশিয়া, চীনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে।
অন্যদিকে, ইরান তার অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং পারস্য উপসাগরের পরিস্থিতি নিয়ে। তারা চীন এবং রাশিয়ার সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আগ্রহী। ইরান-সৌদি সম্পর্কের অবনতি এবং ইরাক ও সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ সহযোগিতা:
চীন, ইরান এবং রাশিয়া তিনটি দেশই তাদের যৌথ অর্থনৈতিক উদ্যোগ আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির আদান-প্রদানকে। রাশিয়া এবং ইরান, চীনকে তাদের বাজারে আরও বেশি প্রবেশের সুযোগ দিতে আগ্রহী, বিশেষত রাশিয়া নিজের শক্তির চাহিদা পূরণে চীনকে প্রধান অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।
চীনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই ত্রি-পাক্ষিক সহযোগিতা বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষভাবে তারা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবাধিকার ইস্যুগুলিতে একটি সম্মিলিত সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
সামরিক সহযোগিতা:
বৈঠকের অংশ হিসেবে তিনটি দেশ সামরিক সহযোগিতার ওপরও আলোচনা করেছে, বিশেষত পারমাণবিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করার বিষয়টি। চীন, ইরান এবং রাশিয়া পরবর্তী সময়ে একে অপরকে বিভিন্ন নিরাপত্তা বিষয়ক সহায়তা প্রদান করতে আগ্রহী।
এই বৈঠকটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ধরনের সমীকরণ সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে তিনটি দেশ নিজেদের শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান এবং সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির কৌশলগত অঙ্গনে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত, পশ্চিমা দেশগুলি এবং যুক্তরাষ্ট্র চীন, ইরান এবং রাশিয়ার এই নতুন উদ্যোগের প্রতি নজর রাখছে এবং এই সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এছাড়াও, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য, বিশেষ করে শক্তির বাজারে এই ত্রি-পাক্ষিক সহযোগিতা একটি নতুন গতিপথ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি বাজারের পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে।
বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এই ত্রি-পাক্ষিক বৈঠকটি চীন, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে নতুন কৌশলগত সম্পর্কের সূচনা হতে পারে, যেখানে তারা একে অপরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত যে, বিশ্বের এই তিনটি দেশ নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় করতে চাইছে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।