গাজায় সাম্প্রতিক সংঘাত আরও তীব্রতর হয়েছে, কারণ ইসরায়েল তাদের সামরিক অভিযান সম্প্রসারিত করেছে। গত দুই দিনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৪৩০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই নতুন হামলা গাজায় শান্তি প্রক্রিয়ার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক হামলার বিশদ বিবরণ
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) জানিয়েছে যে তাদের বাহিনী গাজার নেটজারিম করিডোর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, যা গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে পৃথক করে। এই হামলা জানুয়ারিতে ঘোষিত অস্ত্রবিরতির অবসান ঘটিয়ে নতুন যুদ্ধের সূচনা করেছে।
IDF আরও জানিয়েছে যে তাদের সামরিক বাহিনী “নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান” চালাচ্ছে এবং একটি “আংশিক সুরক্ষা বলয়” তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। এই সুরক্ষা বলয় তৈরি হলে, গাজার উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণ অংশে যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়বে, যা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে আরও কঠিন করে তুলবে।
জাতিসংঘ কম্পাউন্ডে বিস্ফোরণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ জানিয়েছে, বুধবার দেইর আল-বালাহ এলাকায় তাদের কম্পাউন্ডে এক বিস্ফোরণে এক কর্মীসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের প্রকল্প পরিচালনা সংস্থা UNOPS জানিয়েছে যে তাদের ভবনের ওপর “বিস্ফোরক পদার্থ ফেলা বা ছোড়া হয়েছে” এবং এটি একটি “বিচ্ছিন্ন অবস্থানে” ছিল। UNOPS-এর প্রধান জর্জ মোরেইরা দা সিলভা বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়,” এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে “অসহনীয়” বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই ঘটনার পূর্ণ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “গাজায় মানবিক সংকট গভীরতর হচ্ছে, এবং আমরা অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের জন্য আহ্বান জানাই।”
ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও মানবিক সংকট
নতুন সামরিক অভিযানের ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পুনরায় বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। গাজার উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণ অংশে যেতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী থেকে বারবার সতর্কবার্তা জারি করা হচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণ অংশও এখন আর নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় অধিবাসীরা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের ফলে গাজার ১৮ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫%। এদিকে, ইসরায়েল মার্চ মাসের শুরুতে গাজায় খাদ্য, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবেশ বন্ধ করে দেয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলের অবস্থান ও হামাসের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “এটি গাজার জন্য শেষ সতর্কবার্তা। হামাস যদি অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তি না দেয়, তাহলে তাদের জন্য পরিণতি হবে সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বিপর্যয়।”
ইসরায়েল জানিয়েছে যে হামাস এখনো ৫৯ জন বন্দিকে আটকে রেখেছে, যার মধ্যে ২৪ জন জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, হামাস জানিয়েছে তারা একটি নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনায় আগ্রহী, তবে ইসরায়েলের শর্তে নয়। তারা একটি আমেরিকান বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
এই নতুন সংঘাতের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েল ও হামাস উভয়পক্ষকে শান্তি আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেটি ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, ইতিমধ্যে নতুন অস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসন বলেছে যে তারা আশা করে ইসরায়েল মানবাধিকার লঙ্ঘন না করবে এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
এদিকে, আরব লিগ এবং মুসলিম বিশ্ব লীগের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের নিন্দা জানানো হয়েছে। তারা বলেছে, “গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দিতে হবে এবং যুদ্ধবিরতির জন্য নতুন আলোচনা শুরু করতে হবে।”
গাজায় নতুন করে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বিশ্ব রাজনীতির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। মানবিক সংকট আরও গভীরতর হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে এই সংঘাত কী পরিণতি ডেকে আনবে তা বলা কঠিন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ একটি স্থায়ী সমাধান না এলে সংঘাত আরও দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।