এই ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রথমে নিঃসন্দেহে একটি সুখবর মনে হতে পারে। তবে এই যুদ্ধবিরতি এই দশকের সবচেয়ে জটিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। এটি কতদিন টিকে থাকবে, তার উপরই নির্ভর করবে ইউক্রেনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন, তাদের সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
সম্ভবত লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় এবং রুশ নাগরিকের মৃত্যুর পর, কোনো পক্ষের পক্ষেই যুদ্ধবিরতির ধারণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হবে। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর চাপ থাকবে প্রমাণ করার জন্য যে তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের “যেকোনো মূল্যে শান্তি” নীতির পথে বাধা নয়।
তিন বছর ধরে ইউক্রেনে রাশিয়ার নিষ্ঠুর আগ্রাসনের পর, যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে জনসাধারণের আগ্রহ না থাকলেও, সাম্প্রতিক মার্কিন-রুশ কূটনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এটি এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ট্রাম্পের শান্তির পরিকল্পনায় নিজেকে অংশীদার হিসেবে দেখাতে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্ভবত কোনো না কোনো ধরনের শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এটি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি নাও হতে পারে, কারণ রাশিয়া আগেও যুদ্ধবিরতি শুরু বিলম্বিত করেছে কৌশলগত কারণে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়াকে বিশ্বাস করা কঠিন। অতীতে তারা কূটনীতিতে কখনোই দীর্ঘস্থায়ীভাবে আন্তরিক ছিল না। একইভাবে, ইউক্রেনও তার সকল ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায় এবং সামনের লাইন বরফের মতো জমে যাক, এটি মেনে নিতে নারাজ, কারণ এতে তাদের বিশাল অংশ চিরতরে হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বর্তমানে মারাত্মক গোলাবারুদ সংকটের মুখে রয়েছে, যার ফলে অধিকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এই যুদ্ধবিরতিকে কঠিন করে তুলবে। যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি, অনিচ্ছাকৃত হামলা বা উস্কানি এই শান্তি নষ্ট করতে যথেষ্ট।
ইতিহাস বলে, রাশিয়া সাধারণত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। তারা ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করেও অস্বীকার করেছিল, ২০১৫ সালের যুদ্ধবিরতির সময়ও ইউক্রেনের শহর দখল করেছিল, এবং ২০২২ সালে বলেছিল তারা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ করবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই করেছে। অতএব, রাশিয়ার দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক।
সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, যদি এই যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হয় এবং ট্রাম্প ইউক্রেনকেই দায়ী করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে যাবে। এ অবস্থায় রাশিয়া আবারও ইউক্রেনের ওপর ব্যাপক হামলা চালাতে পারে, যেখানে পশ্চিমা সামরিক সহায়তা কমে গেছে এবং ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রস্তুতির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, “এখন বল রাশিয়ার কোর্টে।” কিন্তু রাশিয়া বরাবরই কূটনৈতিক চালবাজিতে পারদর্শী – তারা খেলায় বল চুরি করতে, নিয়ম নিয়ে বিতর্ক করতে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে শিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ওস্তাদ।
এই যুদ্ধবিরতি সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে রাশিয়ার আচরণ এবং পশ্চিমা বিশ্ব কতটা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকে তার ওপর।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধবিরতি: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি
### ভূমিকা
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রাথমিকভাবে একটি সুখবর মনে হলেও এটি অত্যন্ত জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তিন বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, দুই পক্ষের জন্যই যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করা রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের অংশ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে এবং কিভাবে এটি কার্যকর হবে, তার ওপরই নির্ভর করবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন।
এই যুদ্ধবিরতি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের “যেকোনো মূল্যে শান্তি” নীতির অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে রাশিয়াকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা এই শান্তি উদ্যোগে বাধা নয়। ফলে পুতিনের জন্য এটি একটি কৌশলগত সুযোগ, যেখানে তিনি নিজেকে শান্তির পক্ষে দেখাতে পারবেন, অথচ গোপনে তার সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন।
ইউক্রেনের জন্য এই যুদ্ধবিরতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ তারা যদি সম্মত হয়, তবে এটি যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার লাভের দিকেই বেশি যেতে পারে। ইউক্রেন যদি লড়াই চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমর্থন হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।
যুদ্ধবিরতি মানে পুরো যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে ৩০ দিনের জন্য সম্পূর্ণ শান্তি। এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে গুলি, ড্রোন হামলা এবং বোমাবর্ষণ চালানো হয়েছে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে সব বন্ধ করা কি সম্ভব?
কিছু বড় চ্যালেঞ্জ:
✅ মানবিক ও সামরিক ভুল: যুদ্ধের মাঠে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একটি ভুল গুলি কিংবা বোমা বিস্ফোরণ পুরো যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিতে পারে।
✅ রাশিয়ার প্রতারণার কৌশল (Maskirovka): অতীতে রাশিয়া যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। তারা নতুন সৈন্য মোতায়েন করতে পারে, নতুন অস্ত্র আনতে পারে এবং যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর শক্তিশালীভাবে আক্রমণ করতে পারে।
✅ ভুয়া তথ্য প্রচার: রাশিয়া অতীতে অনেকবার ভুল তথ্য ছড়িয়ে ইউক্রেনকে দোষারোপ করেছে। এই যুদ্ধবিরতিতেও রাশিয়া যদি কোনো হামলা চালায়, তবে তারা সেটি ইউক্রেনের ওপর দোষ চাপিয়ে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করতে পারে।
ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধবিরতি মানে সামরিক শক্তি পুনর্গঠনের একটি সুযোগ, কিন্তু একইসাথে এটি একটি বড় ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে।
মূল ঝুঁকিগুলো:
1️⃣ আন্তর্জাতিক সমর্থন কমে যাওয়া: যদি যুদ্ধবিরতি দীর্ঘ হয় এবং নতুন কোনো সংঘর্ষ না হয়, তবে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে সাহায্য পাঠানো কমিয়ে দিতে পারে।
2️⃣ রাশিয়ার পুনর্গঠন: রাশিয়ার কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতির সময় নতুন সেনা আনতে পারে, অস্ত্র উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং নতুন সামরিক কৌশল নিতে পারে।
3️⃣ ভূখণ্ড হারানোর স্থায়ী ঝুঁকি: ইউক্রেন যদি যুদ্ধবিরতি মেনে নেয় এবং সামনের লাইন অপরিবর্তিত থাকে, তবে এটি রাশিয়ার দখল করা এলাকাগুলো স্থায়ীভাবে হারানোর শঙ্কা তৈরি করবে।
রাশিয়া যুদ্ধবিরতির সময় কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করতে পারে:
- প্রচার কৌশল: তারা বিশ্বকে দেখানোর চেষ্টা করবে যে তারা শান্তি চায়, কিন্তু ইউক্রেনই সংঘর্ষ চায়।
- সামরিক প্রস্তুতি: যুদ্ধবিরতির সময় সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো এবং অস্ত্র তৈরি করা।
- ভুয়া যুদ্ধবিরতি: অতীতের মতো যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ছোটখাট হামলা চালানো এবং ইউক্রেনকে উত্তেজিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন ইউক্রেনের প্রতি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে, সেটিই মূল প্রশ্ন। যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হলে ট্রাম্প যদি ইউক্রেনকেই দোষারোপ করেন, তবে ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমা সামরিক সহায়তা কমতে পারে। এটি রাশিয়ার জন্য একটি বড় কৌশলগত সুযোগ তৈরি করবে।
ইতিহাস বলছে, রাশিয়া কখনোই দীর্ঘমেয়াদী শান্তি চায়নি। তারা কৌশলগত সুবিধা নিতে যুদ্ধবিরতির সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। ইউক্রেনের জন্য এটি একটি কঠিন সময়, কারণ তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় রাখতেও চায়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই কার্যকর হবে, নাকি এটি রাশিয়ার আরেকটি কৌশলগত চাল মাত্র? ভবিষ্যৎ বলে দেবে, কিন্তু ইতিহাস আমাদের সতর্ক থাকতে শেখায়।