২০২৩ সালে নিউইয়র্কে একজন আমেরিকান শিখ নাগরিককে হত্যাচেষ্টার ঘটনা নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) এবং ভারতীয় ছয়টি কূটনীতিকের জড়িত থাকার অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই অভিযোগটি তুলে ধরেছে।
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইউএসসিআইআরএফ দাবি করেছে, তাদের কাছে কানাডা সরকারের গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, যার ভিত্তিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ভারত সরকারের কর্মচারী বিকাশ ইয়াদভের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। ইউএসসিআইআরএফ উল্লেখ করেছে, মার্কিন বিচার বিভাগ বিকাশ ইয়াদভের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে এবং এই ঘটনার সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
ইউএসসিআইআরএফ তাদের প্রতিবেদনে ভারতকে “কান্ট্রি অফ পার্টিকুলার কনসার্ন” (CPC) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। সিপিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এমন দেশগুলোর জন্য দেওয়া হয় যেগুলি বিশেষভাবে গুরুতরভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনে জড়িত বা এসব লঙ্ঘনের ব্যাপারে সহনশীলতা প্রদর্শন করে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আক্রমণের বেশ কিছু ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। ইউএসসিআইআরএফ এসব ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মার্কিন সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে যাতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
ইউএসসিআইআরএফ-এ বলা হয়েছে, এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করা একটি সংস্থা, যার উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতার সার্বজনীন অধিকার পর্যবেক্ষণ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কংগ্রেসের কাছে নীতিগত সুপারিশ করা। এই সংস্থা আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন (IRFA) অনুযায়ী কাজ করে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: ইউএসসিআইআরএফ-এর প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন পর ভারত সরকার তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক মনোভাব এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিততার অভিযোগ করেছে। ভারতের দাবি, ইউএসসিআইআরএফ তাদের প্রতিবেদনে ভারতের সামাজিক বাস্তবতা এবং বহুত্ববাদী কাঠামো সম্পর্কে ভুলভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছে।
ভারত সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউএসসিআইআরএফ ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কোনও সত্যিকার উদ্বেগ প্রকাশ করছে না, বরং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতকে ভুলভাবে তুলে ধরছে। ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের দেশে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং এসব ধর্ম একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে, এমন একটি বাস্তবতাকে ইউএসসিআইআরএফ স্বীকার করতে চায় না বলে দাবি করেছে ভারত।
প্রতিবেদনে ভারত দাবি করেছে যে, তারা কখনও আশা করেনি ইউএসসিআইআরএফ তাদের দেশের বহুত্ববাদী কাঠামো এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে সঠিকভাবে প্রতিবেদন দেবে। ভারত বলেছে, “আমরা জানি না ইউএসসিআইআরএফ কখনও ভারতীয় সমাজের বাস্তবতা এবং এর ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেবে।”
ভারতের এই প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবেদন নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটি ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোভাবকে পুনরায় আলোচনার সূচনা করেছে।
নিউইয়র্কে শিখ নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর অভিযোগপত্র প্রকাশ করেছে, যাতে জানা যায় যে, এই ষড়যন্ত্রের সাথে নিখিল গুপ্তা নামক একজন ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। নিখিল গুপ্তা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তিনি গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার জন্য একজন ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকে সফল হতে দেয়নি, এবং তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এতটাই বিচলিত হন যে, তিনি সিআইএ-র ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস এবং ডিরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যাভ্রিল হেইনসকে সশরীরে ভারতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ব্যাপারে আরও তথ্য পাওয়া এবং তদন্তের পরিস্থিতি বুঝে দেখা। এই সময় ভারত সরকারও উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়।
এ ঘটনায় ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার মাত্র কয়েক মাস পর, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার দেশে থাকা এক শিখ নাগরিক, যিনি একজন খালিস্তানি নেতা ছিলেন, তাকে হত্যা করতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর এজেন্টরা জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, কানাডার কাছে এই হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এর পরেই কানাডা এবং ভারতের মধ্যে এক অপ্রত্যাশিত কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এই পরিস্থিতিতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের সন্ত্রাসবাদে সহায়তার অভিযোগে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এই ঘটনাটি ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের বদনাম বাড়তে পারে এবং এই ধরনের অভিযোগগুলি দেশটির আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। আবার, ভারত সরকার এই অভিযোগগুলি অস্বীকার করেছে এবং একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কানাডার অভিযোগ মিথ্যা এবং তারা কোনো খালিস্তানি নেতা হত্যার সঙ্গে জড়িত নয়। তবে, এই ব্যাপারে কানাডার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য দাবি করা হয়েছে এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উন্মোচন করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া, এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রও একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের সরকারী তদন্তগুলোতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছে। তাদের অভিপ্রায় হলো এই ঘটনার পুরো বিষয়টি খোলাসা করা এবং একে যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখতে।
এই ঘটনায় একদিকে যেমন ভারত এবং কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলো ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কও আরও জটিল হয়ে উঠেছে। আগামীতে এই ঘটনার পুরো বিশ্লেষণ ও তার ফলাফল গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে ভারত এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের নির্ধারণে।