জার্মানির সেনাবাহিনীর ওপর বিনিয়োগে সেভাবে পরিবর্তন এবং ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রভাব
জার্মানির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রালফ হামারস্টেইন একটি মুচকি হাসি দিয়ে একটি রিটোরিক্যাল প্রশ্ন করেছিলেন: “আপনি কি পুতিনের ওপর বিশ্বাস করতে পারেন?” এ প্রশ্নের উত্তর ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ একইভাবে জানাবে — না। বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধের অবস্থা, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এবং বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে মস্কোর পক্ষে একটি চুক্তির চেষ্টা করছে, সেখানে ইউরোপের দেশগুলো তাদের নিজস্ব সামরিক শক্তিতে নজর দিচ্ছে, যা কয়েক দশক পর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
জার্মানি, যা ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশগুলোর একটি, সেখানে এই পরিবর্তন সবচেয়ে স্পষ্ট। দেশটির সেনাবাহিনী, যাকে “বুন্ডেসওয়ের” (Bundeswehr) বলা হয়, একাধিক বছর ধরে বিনিয়োগের অভাবে পড়ে ছিল। তবে এই পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
জার্মানির চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী ফ্রিডরিখ মের্জ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখনই জার্মানির জন্য সঠিক সময়, যেহেতু দেশটি তার সেনাবাহিনীতে এমন বিনিয়োগ করবে যা কেবলমাত্র শীতল যুদ্ধের পর থেকে দেখা যায়নি। তিনি জানিয়েছেন যে দেশটি তার সামরিক খাতে ব্যাপক অর্থায়ন করবে, যা দেশে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংকটের প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম করবে।
জার্মানি সম্প্রতি একটি বড় রিফর্ম পাস করেছে যা তাদের সাংবিধানিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সংশোধন করেছে, যার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো তহবিল খোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যদি জার্মানি তার জিডিপির ৩.৫% সামরিক খাতে ব্যয় করতে থাকে, তাহলে এই ব্যয়ের পরিমাণ এক দশক পর প্রায় €৬০০ বিলিয়ন (৬৫২ বিলিয়ন ডলার) হতে পারে।
কেননা জার্মানির সামরিক বাহিনী এই পরিবর্তন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সিএনএন তাদের এক দিনের সময় বুন্ডেসওয়ের সঙ্গে কাটিয়েছে, যেখানে তারা এক অজ্ঞাত স্থানে পাঁচটি ন্যাটো মিত্রদেশের সঙ্গে একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলনে অংশগ্রহণ করেছিল। এই অনুশীলনে একটি “বিদেশি শত্রু” দ্বারা ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর আক্রমণের সিমুলেশন করা হয়েছিল।
এই সিমুলেশন সম্পর্কে হামারস্টেইন সিএনএনকে বলেন, “জার্মানি ইউরোপে একটি সক্ষম জাতি, এবং অন্য জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করতে হবে। আমরা ইউরোপে একটি দায়িত্বশীল অংশীদার এবং একটি বড় দেশ। আমাদের এগিয়ে আসতে হবে, এবং আমরা তা করব।”
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ, ইউরোপের জন্য একটি বিপজ্জনক মুহূর্ত হিসেবে দেখা হয়েছিল। এটি ছিল সেই সময় যখন যুদ্ধ ফের ইউরোপে ফিরে এসেছে এবং যা ১৯৯১ সালে লৌহ পর্দার পতনের পর নিরবতা বিরাজ করছিল, তা ভেঙে গেছে।
এই ঘটনার পর জার্মানিতে যে সময়টি শুরু হয়েছিল, তা এক নতুন যুগের সূচনা — যার নাম “জেইটেনওয়েন্ডে” (Zeitenwende) বা “মোর চালু হওয়া”। এটি ছিল একটি নতুন সময়ের সূচনা, যেখানে জার্মানি তার সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।
এ সময় জার্মানির চ্যান্সেলর অলাফ শলৎসও তার বক্তব্যে বলেন, “দেশটি একটি নতুন প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন এবং বুন্ডেসওয়েরকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।”
তার এই সিদ্ধান্তের ফলে, তিনি একটি এককালীন €১০০ বিলিয়ন তহবিল ঘোষণা করেন, যা বুন্ডেসওয়েরে ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হবে। এই অর্থায়নের জন্য শলৎসকে জার্মানির সাংবিধানিক আইন সংশোধন করতে হয়েছে, যা দেশের মূল সংবিধান।
এটি স্পষ্ট যে, জার্মানি নিজেকে তার সামরিক শক্তি আরও শক্তিশালী করতে চায় এবং ইউরোপে একটি নতুন সামরিক হাব হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এটি বিশ্বের সামনে একটি বড় বার্তা দিচ্ছে যে, ইউরোপের দেশগুলো তাদের সামরিক সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে চায়।
এই পরিবর্তনের ফলে ইউরোপে রাজনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কের মানচিত্রে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে, যেখানে জার্মানির নেতৃত্বে ইউরোপ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।