Muhammad Al-Helal
গনতন্ত্র গনতন্ত্র বা নির্বাচন নির্বাচন খেলা আমাদের জীবনে শুরু হয়েছে স্কুল জীবন শুরু থেকে বা তারও আগে।
এই খেলা শুরু করেছি ১৯৯০ এর দশকে যখন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন থেকেই বুঝি গনতন্ত্র মানে মারামারি। মারামারি নাহলে নির্বাচন বা গনতন্ত্র হয়না। তাই আমাদের এই খেলা শুরুর আগে থেকেই মারামারি করার জন্য সরঞ্জামাদি যোগাড় শুরু হতো।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটি খাল ছিল পরবর্তীতে রাস্তা হয়। বর্তমান যেটি মধুমতি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই খালের উভয় পাশে যারা বসবাস করতাম তাদের ছিল একটি দল। এই খেলায় দুইটা দল ছিল। আরেকটি দল অন্য খালের তীরবর্তী বাড়ির সদস্যরা। এই দল দুটির সদস্যরা মূলত প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়ারা ছিলাম। সঙ্গত কারণেই সদস্যদের ছদ্মনাম ব্যবহার করছি।
আমাদের দলনেতা বা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন আরোয়ার। তার নেতৃত্বে আমি সহ আমরুল, যাবলু, উরাদ, রিকবাল, জামেরিকা ছিলাম।
অপরপক্ষে দলনেতা হতেন মাঝে মাঝে আন্নু যিনি এখন দুনিয়ায় নেই। অন্যজন এলিম তিনি বর্তমান সুপার পাওয়ার একটি দেশের প্রবাসী। ঐ পক্ষের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন মালিম, কালিম, ছালামগীর, উন্নু।
এই খেলা শুরুর আগে আমরা যে ধরনের সরঞ্জামাদি গোছাতাম তা হলো ঝুড়ি, লাটিম(গাছে ধরে একধরনের ছোট ছোট গোলাকার সবুজ ফল)। ঝুড়ি ছিল দুই ধরনের একধরনের ঝুড়ি হলো চিতল অর্থাৎ মাটি কাটা ঝুড়ি। আরেক ধরনের ঝুড়ি একটু গভীর অর্থাৎ গোবর ফেলা ঝুড়ি। ঝুড়ি গুলো ব্যবহার করতাম ঢাল আর লাটিম গুলো বোমা হিসাবে।
এই গনতন্ত্র বা নির্বাচন বা মারামারি খেলার স্থান ছিল অনুরদের বাড়ির পাশে যেখানে পূর্বে উল্লেখিত খাল দুটি একত্রিত হয়ে নতুন একটি খালে মিলিত হয়েছে অর্থাৎ তেখাল।
মূলত সদস্য সংখ্যার দিক দিয়ে আমরা একজন বেশি ছিলাম। নির্বাচনের সময় লোক হায়ার করা হতো। সেক্ষেত্রে আমরা হায়ার করতাম সাধারণত অগর, কিলিয়ানসহ আরো কয়েকজনকে।
আর অপরপক্ষে হায়ারে আসত দাদু, মিয়ারসহ কয়েকজন। কখনো কখনো কোন পক্ষে সমবয়সী আত্মীয়-স্বজন আসলেই সেই পক্ষ নিজেদের শক্তিশালী মনে করতাম।
সর্বশেষ ফলাফল হয় যে দল মারামারি করে বিপরীত দলকে ধাওয়া করে বাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারে সেই দলই জয়ী। নির্বাচন বলতে এটাই বুঝাত। মারামারির দিক থেকে আমাদের বিপক্ষ দল বেশি শক্তিশালী ছিল। তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পেশি শক্তির বলে জয়লাভ করে রাজত্ব করত। যদিও ভোটার বা সদস্য সংখ্যা আমাদের বেশি ছিল।
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পেশাগত কারণে প্রায় জামালপুর যেতে হত। সেখান একটি নির্বাচনে শুনছিলাম এরকম ঘটনা পাশবিক শক্তির কারণে একটি দলকে জয়ী ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিল। আর মাগুরা উপনির্বাচনতো গনতন্ত্রের নেগেটিভ ল্যান্ডমার্ক।
যদি পাশবিক শক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় সর্বশক্তি গনতন্ত্রের নামে সংঘটিত নির্বাচনের সঠিক সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রকাশ করতে না পারে তবে রাষ্ট্রীয় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান করা অনর্থক।
যোগ্যতা, জ্ঞান, সততা যেখানে কোন বিবেচ্য বিষয় নয় বরং যে ভোট বেশি পায় ভোটারদের যোগ্যতা যাই হোক না কেন বা যার পেশি শক্তি বেশি সে জয় লাভ করুক বা না করুক রাজত্ব করে সেটি নিশ্চয় মানবকল্যাণের জন্য উপযোগী হতে পারেনা। এই ধরনের ব্যবস্থার নাম গনতন্ত্র হলেও সেটি অসার। সুতরাং এটি পাগলের সিদ্ধান্ত বা বিশৃঙ্খলাতন্ত্র বৈকি। কারন একজন অযোগ্য লোক কোন কারনে ভোট বেশি পেয়েই যোগ্য হয়ে যায় না। কিন্তু আমরা তাকে আমাদের তথা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব তুলে দেই। তারপর তিনি আমাদের ভাগ্য নিয়ে তার জ্ঞান, যোগ্যতা অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাই করে হয়তো আমাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন।
আবার একজন জ্ঞানী, যোগ্য এবং সৎ মানুষ কোন কারণে বেশি ভোট না পেলেই তিনি অযোগ্য হয়ে যান না। কিন্তু আমরা তাকে অযোগ্যদের কাতারের দাঁড় করিয়ে দেই এই গনতন্ত্র তথা বিশৃঙ্খলা তন্ত্রের মানদণ্ড দিয়ে।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া দুটি পলিসির মধ্যে একটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গনতন্ত্র পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া বা আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নত ভাবার জন্য গৃহিত একটি পলিসি।
গনতন্ত্রের মূল শক্তি হলো অধিক জনসংখ্যা। অর্থাৎ যার যত জনসংখ্যা বা জনসমর্থন সেই জয়ী। আর যারা প্রার্থী হবেন তারা পাগল, মূর্খ, অশিক্ষিত, অযোগ্য, সন্ত্রাসী, কালোবাজারি, দূর্নীতি পরায়ন, ঘুষখোর, সূদখোর ইত্যাদি হলেও বর্তমান প্রচলিত গনতন্ত্রের কিচ্ছু আসে যায় না। যেকোনোভাবে অধিক জনসংখ্যার সমর্থন পেলেই সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাদের হাতে ন্যাস্ত হয়।
আবার যারা ঐ সমস্ত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন তাদের মধ্যেও যদি উপরিউক্ত পাগল, মূর্খ, অশিক্ষিত, অযোগ্য, সন্ত্রাসী, কালোবাজারি, দূর্নীতি পরায়ন, ঘুষখোর, সূদখোর বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকে তাহলেও প্রচলিত গনতন্ত্রের কিচ্ছু আসে যায় না।
সেকারনেই বোধ হয় গণতন্ত্রকে মূর্খের ও অযোগ্যের শাসন ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন প্লেটো এবং এরিস্টটলের মতো বিশ্ব বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া বা আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নত ভাবার জন্য গৃহিত আরেকটি পলিসি। যার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম দেশ গুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ।
গনতন্ত্রের জন্য যত জনসংখ্যা হয় ততই ভালো। সেদিক বিবেচনা করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল বা পলিসি অবলম্বন করার কথা। সেটি না করে মুসলিম বিশ্বে গনতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
তবে পশ্চিমা বা পশ্চিমা নীতি অনুসরণ করে এমন অনেক দেশে আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয় বরং বিপরীত পলিসি অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল হিসাবে যারা অধিকবার মা বাবা হন বা অধিক সন্তান গ্রহণ করেন তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্তান গ্রহণ করলে যে প্রোনোদনা দেওয়া হয় সে বিষয়ে গনমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবর তুলে ধরছি-
চীনে বাড়ি বাড়ি ফোন করে সন্তান নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়
চীনের স্থানীয় সরকার এবার পরিবারের প্রতি সরাসরি যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। বিবাহিত নারীদের ফোন করে তাদের সন্তান ধারণের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হচ্ছে এবং সন্তান নেওয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার জন্য ১৪ হাজার ডলার পর্যন্ত সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও, চীনের কিছু অঞ্চল সরকারি স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য পরিসেবা বিনামূল্যে প্রদান করছে।
প্রেম, বিয়ে, সন্তান ধারণে সচেতনতা প্রচার
চীন সরকার আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রেম শেখানোর কোর্স’ চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে তরুণদের প্রেম, বিয়ে এবং সন্তান ধারণের উপকারিতা ও গুরুত্ব শেখানো হবে। এতে তরুণদের মধ্যে সম্পর্কের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব এবং ভবিষ্যতে পরিবার গঠনে আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এছাড়া, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো নিয়মিতভাবে সন্তান জন্মানোর উপকারিতা নিয়ে প্রকাশনা করছে। পিপলস ডেইলি এবং লাইফ টাইমসের মতো সংবাদপত্রে সন্তান জন্মানোর স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক উপকারিতা সম্পর্কে নিবন্ধ প্রকাশ করা হচ্ছে। (২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, কালবেলা)
সন্তান নিলেই ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাবেন মা-বাবা
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের খুব কাছাকাছি। এই অবস্থায় দেশগুলো দম্পতিগুলোকে সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। সর্বশেষ দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার পরিকল্পনা করেছে, তারা দেশটির দম্পতিগুলোকে সন্তান লালন-পালনের ভর্তুকি হিসেবে ১০ কোটি ওন বা ১ লাখ ১২ হাজার ডলার দেবে; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকার কাছাকাছি। (০৬ মে ২০২৪, আজকের কাগজ)
নিম্ন জন্মহার এবং নাগরিকদের অন্যান্য দেশে থিতু হওয়ার প্রবণতার কারণে এক প্রজন্মের মধ্যেই হাঙ্গেরির জনসংখ্যা ১০ লাখ কমে গেছে। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ৯৮ লাখ। এতে ধীরে ধীরে দেখা দিতে শুরু করেছে শ্রম সরবরাহে ঘাটতি। কিন্তু দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান অভিবাসীদের গ্রহণ করে শ্রমবাজারের এই সংকট নিরসনের ঘোরতর বিরোধী। তিনি চান, দেশের জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি। গত সপ্তাহে ওরবান ঘোষণা করেছেন, বেশি সদস্যের পরিবারগুলোর জন্য দেওয়া হবে ভর্তুকি, কর রেয়াত, বিশেষ অনুদান ও গাড়ি। বেশি সন্তান নিয়ে একটি পরিবার পেতে পারে সর্বোচ্চ এক লাখ ৩৫ হাজার ডলার পর্যন্ত। চারটি বা তারও বেশি শিশুর আছে এমন পরিবারগুলোই পাবে সবচাইতে বেশি পরিমাণ আর্থিক আনুকূল্য। (২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বাংলা ট্রিবিউন)
সুতরাং পশ্চিমারা নিজেদের দেশে গনতন্ত্র এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি কৌশল আর মুসলিম দেশে গনতন্ত্র এবং জনসংখ্যা হ্রাস করনের যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা কৌশলগত আর নীতি নৈতিকতার বিবেচনায় পরস্পর বিরোধী।
এই নির্বাচন নির্বাচন বা গনতন্ত্রের খেলায় মারামারি, ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি আর জীবননাশের ঘটনা অনিবার্য। মুসলিম বিশ্বের নির্বাচন হোক বা অন্য যে কোন উপায়ে হোক জনসংখ্যা হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ হলেই পশ্চিমাদের গৃহিত পলিসির উদ্দেশ্য সফল।
বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের সকল পলিসি স্যামুয়েল হান্টিংটোনের “সভ্যতার সংঘাত” থিসিস দ্বারা প্রভাবিত।
কারন স্যামুয়েল হান্টিংটোন তার “সভ্যতার সংঘাত” থিসিসে দেখিয়েছেন মুসলিম জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ ইসলামী সভ্যতা বিশ্ব শাসন করবে। আর সেই আশঙ্কা থেকেই যেকোনো উপায়ে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাস করা পশ্চিমাদের পলিসি প্রতিযোগিতা। হোক সেটি মুসলিম জন অধ্যুষিত এলাকায় ধর্ম বিশ্বাস , রাজনৈতিক স্বাধীনতা, আধিপত্য বা সীমানা নিয়ে যুদ্ধ, গনতন্ত্রের নামে সংঘাত, বোম্বিং, পরিবার পরিকল্পনা নীতি বা পারস্পরিক সাংঘর্ষিক কোন নীতি সেদিকে লক্ষ্য করার সময় তাদের নেই। এর প্রতিফল হিসাবে হয়তো আমরা ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে মুসলিম জন অধ্যুষিত এলাকায় বেশি সংঘাত দেখতে পাই যেমন কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে শিয়া-সূন্নী দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে তুর্কিয়ে-কুর্দিস্তান, নেতৃত্বের লড়াই নিয়ে ইরাক-ইরান ও ইয়ামেন-সাউদী আরাবিয়া, আদর্শ নিয়ে তালিবান-নর্দান এলায়েন্স, গনতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের আন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দলও এর বাইরে নয়।
তবে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের জনক এডওয়ার্ড সাঈদ হান্টিংটনের জবাব দিয়েছিলেন তার ‘ক্ল্যাশ অফ ইগনোরেন্স’ বইয়ে। তিনি হান্টিংটনের এই তত্ত্বকে বর্ণবাদী বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন এবং হিটলার যেমনভাবে ইহুদিদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন, হান্টিংটনও তেমনিভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন বলে মতামত
দিয়েছেন।
আরেক বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি এই তত্ত্ব নিয়ে বলেছেন, এটি মূলত স্নায়ুযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ফাঁকা স্থানকেই পূরণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই তৈরি করা হয়েছে, যাতে তাদের নাম দিয়ে যেকোনো ধরনের নৃশংসতা চালানো যায়।
বিশ্বে চলমান গনতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমরতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রে বিশ্ববাসীর অভিজ্ঞতা তিক্ত। শুধু ইসলামতন্ত্র যেখানে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠ সকলের জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে বয়ান করেছে। কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন,
اَ لَّذِيۡنَ اِنۡ مَّكَّنّٰهُمۡ فِى الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوة
وَاٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَاَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَنَهَوۡا عَنِ
الۡمُنۡكَرِ ؕ وَلِلّٰهِ عَاقِبَةُ الۡاُمُوۡرِ
﴿٤١﴾
‘(এরা হল) যাদেরকে আমি যমীনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে নিষেধ করে, সকল কাজের
শেষ পরিণাম (ও সিদ্ধান্ত) আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।’ (সুরা : হজ : আয়াত : ৪১)
ইসলাম তন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম উদ্দেশ্য ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন
یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلۡنٰكَ خَلِیۡفَۃً فِی الۡاَرۡضِ فَاحۡكُمۡ بَیۡنَ
النَّاسِ بِالۡحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الۡهَوٰی فَیُضِلَّكَ عَنۡ
سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَضِلُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ
لَهُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌۢ بِمَا نَسُوۡا یَوۡمَ الۡحِسَابِ
﴿۲۶﴾
‘(হে দাঊদ), নিশ্চয় আমি তোমাকে যমীনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার কর আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য কঠিন আযাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ২৬)
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা এমনিভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন,
سَمّٰعُوۡنَ لِلۡكَذِبِ اَكّٰلُوۡنَ لِلسُّحۡتِ ؕ فَاِنۡ جَآءُوۡكَ
فَاحۡكُمۡ بَیۡنَهُمۡ اَوۡ اَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ ۚ وَ اِنۡ تُعۡرِضۡ
عَنۡهُمۡ فَلَنۡ یَّضُرُّوۡكَ شَیۡئًا ؕ وَ اِنۡ حَكَمۡتَ فَاحۡكُمۡ
بَیۡنَهُمۡ بِالۡقِسۡطِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ
﴿۴۲﴾
‘তারা মিথ্যার প্রতি অধিক শ্রবণকারী, হারামের অধিক ভক্ষণকারী। সুতরাং যদি তারা তোমার কাছে আসে, তবে তাদের মধ্যে ফয়সালা কর অথবা তাদেরকে উপেক্ষা কর আর যদি তাদেরকে উপেক্ষা কর, তবে তারা তোমার কিছু ক্ষতি করতে পারবে না, আর যদি তুমি ফয়সালা কর, তবে তাদের মধ্যে ফয়সালা কর ন্যয়ভিত্তিক। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যয়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪২)
পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُكُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی
اَهۡلِهَا ۙ وَ اِذَا حَكَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡكُمُوۡا
بِالۡعَدۡلِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمۡ بِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ
كَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا
﴿۵۸﴾
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতইনা সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا
الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡكُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ
شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ كُنۡتُمۡ
تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِكَ خَیۡرٌ وَّ
اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا
﴿۵۹﴾
‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৯)
তবে যারা ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের জন্য যে বিধান নাযীল হয়েছে সে বিধান মোতাবেক ফয়সালা করেনা তাদের যালিম আখ্যা দিয়ে বলেন,
وَ كَتَبۡنَا عَلَیۡهِمۡ فِیۡهَاۤ اَنَّ النَّفۡسَ بِالنَّفۡسِ ۙ وَ
الۡعَیۡنَ بِالۡعَیۡنِ وَ الۡاَنۡفَ بِالۡاَنۡفِ وَ الۡاُذُنَ
بِالۡاُذُنِ وَ السِّنَّ بِالسِّنِّ ۙ وَ الۡجُرُوۡحَ قِصَاصٌ ؕ فَمَنۡ
تَصَدَّقَ بِهٖ فَهُوَ كَفَّارَۃٌ لَّهٗ ؕ وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡكُمۡ بِمَاۤ
اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
﴿۴۵﴾
‘আর আমি এতে তাদের উপর অবধারিত করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান ও দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমের বিনিময়ে সমপরিমাণ জখম। অতঃপর যে তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা কাফ্ফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই যালিম।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৫)
তবে এই ইসলাম তন্ত্রের মধ্যে সমস্যা খুঁজে পান যারা ইসলাম তন্ত্র এসে গেলে বিশৃঙ্খলা করতে পারবেন না তারা। আবার কোন কোন দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় সেখানে ইসলাম তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো অলৌকিক কান্ড মাত্র।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জন্য তো ইসলামতন্ত্র রয়েছে তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেশের জন্য একটি সাধারণ তন্ত্র বের করা যায়।
বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর জন্য যেমন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়োগ দেয়া হয়। সেই নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্য থেকেই পরবর্তীতে পেশাদারিত্ব এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রধান হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
সাধারণত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কোন ধরনের পেশাদারিত্ব বা যোগ্যতার অভাব বা অভিযোগ জানা যায় না।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এমন একটি বিভাগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে অথবা বর্তমান দেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে যে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে সেখানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভর্তি হবেন। সেখানে ভর্তিকৃতদের মধ্য থেকে যারা উত্তীর্ণ হবেন তাদের সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ইত্যাদির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট একটি কমিশন নির্দিষ্ট বাছাই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার স্থানীয় সরকারের প্রথম ধাপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, তারপর
সভাপতি, এরপর উপজেলা পরিষদের সদস্য ধারাবাহিকভাবে সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত করবেন।
যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী থাকবেন তারা ক্যারিয়ারের শুরুতেই প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। যারা বাছাই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপরিচালনার মেইনস্ট্রিম কর্মকান্ডে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না তারা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকান্ডে নিযুক্ত হবেন। এক্ষেত্রে জনগণ সন্তুষ্ট থাকবেন কেননা রাষ্ট্র বিজ্ঞানী দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। তবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে সাপ্লাই ডিমান্ড চেইন ঠিক রাখতে হবে।
এ পদ্ধতি শুধু রাষ্ট্র পরিচালনা নয় অন্যান্য সেক্টরেও অনুসরণ করলে দেশে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির পথ উন্মুক্ত হবে। কেননা কেউ ক্যারিয়ারের মাঝ পথে এসে তার ক্যারিয়ার বদল করার সুযোগ পাবেননা বরং নিজ যোগ্যতার সেক্টরে মনোযোগ সহকারে কাজ করে অধিক যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ পাবেন।
বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে “ক্লাসের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয় আর রাস্তাঘাট, দালানকোঠা বানায়। মাঝারি ধরনের শিক্ষার্থী প্রশাসনে যুক্ত হয়ে ঐ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের পরিচালনা করে। আর সবচেয়ে খারাপ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেইল করে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।” তবে উপরিউক্ত পদ্ধতি চালু হলে আমাদের আর ফেইল করা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে না এবং প্রবাদটি অকার্যকর হয়ে পড়বে।
এটিকে যোগ্যতাতন্ত্র বলা যেতে পারে। যোগ্যতাতন্ত্রের সঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ কি সেটি আমি জানিনা যেমন গনতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ যথাক্রমে democracy বা autocracy। তবে সমস্ত প্রক্রিয়ায় সততা থেকে বিচ্যুত হলে যোগ্যতাতন্ত্রও ব্যার্থ হবে।
এভাবে অন্যান্য তন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ইসলাম তন্ত্রের পাশাপাশি যোগ্যতাতন্ত্রের মাধ্যমেও বিশ্ববাসীর মুক্তি হতে পারে।
MPhil Researcher (ABD)
Department of International Relations
Dhaka University