উত্তর কোরিয়ার প্রায় ৪,৭০০ সৈনিক রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে অংশ নিয়ে নিহত বা আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (National Intelligence Service বা NIS)। এর মধ্যে অন্তত ৬০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর বাকি ৪,১০০ জন বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে প্রায় ২,০০০ জন আহত উত্তর কোরিয়ান সৈন্যকে রাশিয়া থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বিমান ও ট্রেনের মাধ্যমে। নিহতদের মৃতদেহ রাশিয়াতেই দাহ করা হয় এবং পরে তাদের ভস্ম উত্তর কোরিয়ায় পাঠানো হয়।
এই তথ্য দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদীয় কমিটির এক গোপন ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনপ্রণেতা লি সেওং কিউন ও কিম বিওং-কি। ব্রিফিংয়ের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা উল্লেখ করে যে, চলতি বছরে রাশিয়ায় আরও প্রায় ৩,০০০ নতুন উত্তর কোরিয়ান সৈন্য পাঠানো হয়েছে, যার ফলে মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২,০০০-এর কাছাকাছি। এর আগে গত জানুয়ারিতে আনুমানিক ৩,০০০ জন উত্তর কোরিয়ান সৈন্য হতাহত হয়েছিল বলে জানানো হয়েছিল। এপ্রিলের শেষ দিকে সেই সংখ্যা ৪,৭০০-এ পৌঁছায়।
উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে যে তারা রাশিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। কিম জং উন এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি “ইউক্রেনীয় নাৎসি দখলদারদের ধ্বংস ও কুরস্ক অঞ্চল পুনরুদ্ধার”-এর লক্ষ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের আত্মত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, রাশিয়া এটি কখনো ভুলবে না।
দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা আরও জানায়, রাশিয়া এই সামরিক সহায়তার প্রতিদান হিসেবে উত্তর কোরিয়াকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, সামরিক ড্রোন এবং গোয়েন্দা উপগ্রহ উৎক্ষেপণ প্রযুক্তি দিয়েছে। তারা আরও জানায়, উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে রাশিয়াকে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য প্রচলিত অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যার বাজারমূল্য বিলিয়ন ডলার পরিমাণ। তবে এখনও পর্যন্ত এর বিনিময়ে রাশিয়া নগদ অর্থ দিয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে ২০২৪ সালে একটি নতুন সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো পক্ষ আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে অপর পক্ষ সামরিক সহায়তা প্রদান করবে। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কেবল সামরিক নয়, অর্থনৈতিক সহযোগিতাও বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সূত্রমতে, প্রায় ১৫,০০০ উত্তর কোরিয়ান শ্রমিক বর্তমানে রাশিয়ায় রয়েছে, যারা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক শিল্প প্রকল্পে কাজ করছে।
এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যে নতুন প্রশ্ন তুলছে। উত্তর কোরিয়ার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং এর মাধ্যমে রাশিয়ার সহায়তা পাওয়া মানে শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া, বিষয়টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, এবং এতে ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা নীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।