বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা – এ সমস্ত ক্ষেত্রেই গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে একযোগভাবে কাজ করতে একমত হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন কেমন? কীভাবে দুর্নীতির মোকাবেলা করা হচ্ছে? এ প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবো।
বাংলাদেশে দুর্নীতি: এক বৈশ্বিক সমস্যা
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্নীতির একটি দীর্ঘ পরিসর রয়েছে। দেশটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকে দুর্নীতির কারণে অনেক সময়ই নিম্ন অবস্থানে চলে যায়। তবে, ১৯৯০ সালের পর থেকে, বিশেষত শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে, সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে দুর্নীতি রোধের জন্য।
বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ (দুদক) কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য হলো দুর্নীতির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং তা দূরীকরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া।
দুর্নীতি দমন কমিশন: একটি সফল মডেল?
দুদক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে, যা মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ও ন্যায্য আইনি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। কিন্তু ২০০৪ থেকে আজ পর্যন্ত বেশ কিছু সময় বাদে দুদক তার কার্যক্রম নিয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে অনেক সময়। তবে এর কিছু সফল উদ্যোগও রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এমনকি বিচার বিভাগের অনেক সদস্যও দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে জাতীয় স্যানিটেশন পরিকল্পনা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ
বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনগত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম আরো জোরদার করতে ‘ব্যাংকিং সেক্টর রেগুলেশন’ এবং ‘অর্থ লন্ডিং’ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কার্যকরী আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ খেলাপি, অর্থ লেনদেনের অস্বচ্ছতা, আর্থিক খাতে অবহেলা- এই সমস্ত বিষয় বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার শাখা গুলোতে আরও বেশি মনিটরিং সিস্টেম প্রবর্তন করেছে, যাতে করে ব্যাংকিং সেক্টরের সাথে কোনো রকম দুর্নীতি বা অনিয়ম না হয়।
শিক্ষা খাতে দুর্নীতি এবং এর প্রভাব
শিক্ষা খাতেও দুর্নীতি একটি অন্যতম সমস্যা। শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষা ব্যবস্থা, ভর্তির ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের খবর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় বিশেষ গোষ্ঠী তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া, অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং মানের দিক থেকে গুরুতর সমস্যা রয়েছে।
বাংলাদেশের স্কুল এবং কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, সমাধান এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
প্রশাসনিক সংস্কার
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন ও সংস্কারের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি অনেক সময়ই জনসাধারণের সেবা পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে, বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে।
এক্ষেত্রে প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা বাড়ানো অপরিহার্য। তবে, এই বিষয়ে কিছু কিছু অগ্রগতি হলেও এখনও বহু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
ব্যবসায়ী মহলে দুর্নীতি
ব্যবসায়ী মহলেও দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, অসাধু প্রভাব বিস্তার, এবং সরকারি প্রকল্পের বন্টন ব্যবস্থা প্রভাবিত হওয়া এই বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেক সময় শিল্পপতিদের ব্যবসা পরিচালনায় সরকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুবিধা দেয়া হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকারি প্রণোদনা ব্যবস্থা এবং সঠিক অবকাঠামোগত সংস্কারেও দুর্নীতি একটি বড় প্রতিবন্ধক।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাজের সচেতনতা
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা সামাজিক আন্দোলন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সরকারের সামাজিক খাতের প্রতি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই সচেতনতা কার্যকরী হতে পারে।
ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা
দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা একযোগে এই সমস্যা মোকাবেলায় কাজ করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন এর জন্য দুর্নীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে দেশটি একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে।