সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন চাল মজুত থাকলেও বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চালকল মালিক ও কিছু কর্পোরেট গ্রুপকে দায়ী করা হলেও তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করছে। অন্যদিকে, কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন লোকসানে, যার দায় কেউই নিতে চাইছে না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাল ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করলেও ব্যবসায়ীরা সংকটের কথা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, খুচরা পর্যায়ে কিছু জায়গায় সংকট থাকতে পারে, তবে উৎপাদন বা সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। তবুও, বাজারে চালের দাম বাড়ছে কেন?
সরকার জানুয়ারি মাসে ১৩ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও এবং আমনের উৎপাদন ভালো হলেও, বাজারে চালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি ৫৪-৫৫ টাকা, পাইজাম ৫৫-৫৭ টাকা, এবং মিনিকেট ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহের তুলনায় ১২-১৫ টাকা বেশি।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে, এক বছরে মিনিকেট চালের দাম ১৩ শতাংশ, মাঝারি চালের ১৪ শতাংশ এবং মোট চালের ৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে বাজার পরিস্থিতি আরো বেশি মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অটো রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলমের মতে, ধানের মৌসুম শেষ হওয়ায় এবং মজুতদারদের কারণে চালের দাম বেড়েছে। তার মতে, সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে, নওগাঁ জেলার চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন সরদার মজুতের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খানের মতে, বেসরকারি পর্যায়ে এক কোটি টন চাল সংরক্ষণের সক্ষমতা থাকলেও, সরকারি মজুত ক্ষমতা মাত্র ২২ লাখ টন। ফলে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি মনে করেন, নতুন ধান উঠার আগে পর্যন্ত চালের দাম বাড়তেই থাকবে।
এদিকে, সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত আমদানি থাকলেও বোতলজাত তেলের সংকট রয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজারে সঙ্কট কাটেনি। অভিযোগ রয়েছে, মাদার ভেসেল থেকে তেল খালাসের পর সাগরে ভাসিয়ে রেখে এবং ডিলারদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ দাবি করেছে, তারা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছে, তবে বোতলজাত করতে সময় লাগছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন জানিয়েছেন, সয়াবিন তেলের সংকটের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম গ্রুপের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বসুন্ধরার আমদানি কমে যাওয়ার কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকলেও, পেঁয়াজ চাষীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গত বছর যেখানে পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা ছিল, বর্তমানে তা ২০-২৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
রাজবাড়ির বালিয়াকান্দির চাষী প্রাণেশ বিশ্বাস জানিয়েছেন, দুই একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে, কিন্তু বর্তমান দামে বিক্রি করলে সেই খরচও উঠবে না। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পনার অভাব এবং অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, বেশিরভাগ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, চাল ও তেলের সিন্ডিকেট এখনো ভাঙতে পারেনি সরকার। কারণ, বড় ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সীমিত।
সূত্র :জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে