মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
সাম্প্রতিক দুইটি হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনীতির হিসাব ওলটপালট করে দিয়েছে। যার একটি ঘটনা রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে আরেকটি খুলনায়। গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার কথিত যুবদলকর্মী মো: সোহাগ নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে প্রথমে কুপিয়ে পরে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড বুধবার ঘটলেও শুক্রবার একটি ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, মৃতপ্রায় সোহাগকে ভারী একটা পাথর দিয়ে বুক মাথা থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার লাশের উপর উঠে আঘাত করার দৃশ্যও দেখা যায় ভিডিওতে।
মুহূর্তেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। জানা যায়, খুনিরাও যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সারা দেশের মানুষ। অপরাধীকে গ্রেফতারের দাবি ওঠে। পাশাপাশি টার্গেট করা হয় পুরান ঢাকার বিএনপিপন্থী রাজনীতিবীদদের। সবশেষে দায় বর্তায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতি। যেহেতু খুনি ও খুন হওয়া ব্যক্তিরা বিএনপির অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ভাঙারি ব্যবসাগুলো সবসময় পেশিশক্তির জোরে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বর্তমানে সারাদেশে বিএনপিকর্মীরা পেশিশক্তি নির্ভর ব্যবসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে দায়টা বিএনপির উপর আসাই স্বাভাবিক।
এই ঘটনায় সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির উপর। সারাদেশে বিএনপিবিরোধীরা মিছিল সমাবেশ করছে। ক্যাম্পাসগুলোতে বিএনপির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নাম ধরে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় ঘটনা খুলনার এবং যুবদল সংশ্লিষ্ট। শুক্রবার খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাকে গুলি করার পর দুই পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। মাহবুবুর রহমান মোল্লা এই বছরের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করে দেশব্যাপী আলোচনায় চলে আসেন। তাকে বহিষ্কার করা হয়।
শুক্রবার মিটফোর্ডের সামনে মো: সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোণঠাসা বিএনপি মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ডের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা মাহবুবুর রহমান হত্যার দায় প্রতিপক্ষের উপর চাপানোর চেষ্টা করে। পাশাপাশি সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে নাটক বলেও প্রচারণা চালায়। পরে জানা যায়, মাহবুব হত্যাকাণ্ড মূলত মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।
উপরের দুটি ঘটনাকে বিএনপি নেতা ও অ্যাক্টিভিস্টরা রাজনীতির পুরোনো খেলার নিয়মে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে ধরা খেয়েছেন। বিএনপির ইমেজ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বেশ কয়েকজন নেতার পদত্যাগের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। আর ঠিক এই কারণেই উঠে এসেছে নয়া বাস্তবতার প্রসঙ্গ।
শুধু রাজনীতি না, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সেক্টর নয়া বাস্তবতার সাথে তাল মেলাতে পারছে না। সবাই ভুলে যাচ্ছে এটা ২০২৫ সাল, ২০০৫ না। ২০০৫ সালে কারো হাতে মোবাইল ফোন থাকাটা ছিল বিস্ময়ের। এখন মোবাইল ফোন না থাকাটা বিস্ময় জন্ম দেয়। ২০০৫-এ খুলনার খবর ঢাকায় আসতে একদিন লাগত। এখন লাগে এক সেকেন্ড। আগে চায়ের দোকান থেকে রাজনৈতিক বোঝাপড়া জন্ম নিয়ে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ত এখন ঘর থেকে বোঝাপড়া পরিণত হয়ে এসে চায়ের দোকানে শেষ হয়।
এখন কাউকে বোঝানের সময় নেই। সবাই নিজের মতো বুঝে নেয়। মিডিয়া চাইলে মানুষকে ভুল বোঝাতে পারে না। তার বড় উদাহরণ দেখেছি সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াগুলো সারাদেশে নিন্দার মুখে পড়েছে এক পাক্ষিক ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা করে। কারণ, এখন জনসাধারণ বলে কেউ নেই, সবাই অসাধারণ। তারা ঢিলের শব্দ শুনে ওজন যাচাই করে না; বরং ঢেউ দেখে ওজন বুঝে নেয়।
এই নয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় জনগনকে ভুল বোঝানোর সুযোগ নেই। চাইলেই যদি জনগনকে ভুল বোঝানো যেত, শেখ হাসিনার হাজার কোটি টাকার প্রপাগাণ্ডা প্রজেক্ট মার খেয়ে রাস্তায় মুখ থুবরে পড়ে থাকত না। সারাদিন জমিতে কাজ করা বয়স্ক মানুষটা আধাঘণ্টা নেট ঘেঁটে জেনে যায় কে রাজনীতি করছে আর কে ভণ্ডামি করছে। কে সত্য বলছে, কে মিথ্যা। কে দেশকে দিতে এসেছে কে নিতে এসেছে। এখন মঞ্চে চাঁদাবাজ নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ নেই। মঞ্চের পেছনে দুই গ্লাস গলায় ঢেলে মঞ্চে এসে মাদকবিরোধী স্লোগান ধরার দিন শেষ। প্রতিটি কথা যেমন স্ক্যান হয়, তেমন স্ক্যান হয় বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। এসবই নয়া বাস্তবতা।
নয়া বাস্তবতার ছোবল থেকে বাঁচার একটা মন্ত্র আছে। তার নাম স্বচ্ছ্বতা। আপনার ভেতরে যা আছে তা প্রকাশ পাবেই। ফলে ভেতরে এক রেখে বাইরে আরেক প্রকাশ করতে গেলে আপনি ধরা। এখন আপনি মানসিকভাবে যা ঠিক তাই প্রকাশ করুন। লোভ থাকলে লোভ প্রকাশ করুন, ত্যাগ থাকলে ত্যাগ। আপনি সত্য হলে সত্য প্রকাশ করুন, মিথ্যা হলে মিথ্যাই। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি রাজনীতি করতেই চান, নিজের ভেতরটা প্রকাশযোগ্য করে রাখুন। লোভ, হিংসা, মিথ্যা ও ভণ্ডামি থেকে দূরে থাকুন। এর কোনো একটা আপনার মনের ভেতর যত যত্নেই রাখেন না কেন, তা প্রকাশ পাবেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাজনীতি যে কঠিন করে দিয়েছে- এখন হয়তো মানছেন না, ধরা খাওয়ার পরে মানবেন।
কথা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক