Joypurhat Correspondent :
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কাটাহার রউফিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ‘আয়া’ পদে ভুয়া অষ্টম শ্রেণির সনদ ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন মোছা. শাহিনা আক্তার নামের এক নারী। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে—যোগ্যতা নয়, বরং প্রভাব, অর্থ ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এই নিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
■ মেধা ও যোগ্যতা উপেক্ষিত
২০২৩ সালের ১৫ মার্চ মাদ্রাসাটি ‘আয়া’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আবেদন করেন মাত্র তিনজন—একজন এইচএসসি ও একজন বিএ পাস। অথচ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা না করা শাহিনা আক্তারই পেয়ে যান চাকরিটি।
শাহিনার জমা দেওয়া সনদে উল্লেখ আছে—তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন ২০০৬ সালে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম ১৪ এপ্রিল ১৯৯২ হলে, তখন তার বয়স হতো মাত্র ১৩ বছর। এছাড়া, অভিযোগ উঠেছে তিনি সে সময় বিবাহিত ছিলেন, যা আইনি ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
■ সনদে গরমিল ও ভিন্ন ঠিকানার রহস্য
শাহিনার সনদ ইস্যু করা হয়েছে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার “পুড়ইল ডুগডুগি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়” থেকে, অথচ তার স্থায়ী ঠিকানা জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায়—স্বামীর বাড়িতে। ওই বিদ্যালয় তার স্বামীর গ্রাম থেকেও প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে।
২০০৬ সালের ১২ মার্চ ইস্যু করা সনদে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জাকারিয়া হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে বর্তমান প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, “আমাদের স্কুলে শাহিনা নামে কোনো শিক্ষার্থী ছিল না।” রেজিস্ট্রার খাতায় কাটাকাটি, সংশোধন ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি উত্তেজিত হয়ে সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেন, “একটা মেয়ের চাকরি হয়েছে, তার পেটে লাথি মারার দরকার কী?” তিনি রেজিস্ট্রার খাতা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান এবং সাংবাদিকদের নাম-ঠিকানা লিখে নেন।
■ সহপাঠীদের জবানবন্দি: “শাহিনা কখনো ক্লাসেই আসেনি”
২০০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রীরা সাংবাদিকদের জানায়, শাহিনা নামে কেউ ওই বছর স্কুলে ভর্তি ছিল না। সহপাঠী ফেরদৌসী বলেন, “আমাদের ব্যাচে হাতে গোনা কয়েকজন মেয়ে ছিল, শাহিনা নামে কেউ ছিল না। ক্লাসে এমন কাউকে কখনো দেখিনি।”
■ বিদ্যালয়ের লিখিত প্রত্যয়ন: “সনদটি ভুয়া”
প্রতিষ্ঠানটির প্যাডে গত ১৪ জুন প্রধান শিক্ষক জাকারিয়া হোসেন স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নে জানানো হয়—“শাহিনার অষ্টম শ্রেণির সনদটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যা ও ভুয়া।” তিনি জানান, কেউ তার স্বাক্ষর নকল করে এ সনদ তৈরি করেছে।
■ মাদ্রাসা সুপারের অবস্থান
কাটাহার রউফিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আব্দুল আলিম বলেন, “লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে সনদ ভুয়া হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আপনার কাছে কী কী ডকুমেন্ট আছে, উপজেলায় গিয়ে অভিযোগ দিন আমার বিরুদ্ধে।”
■ শাহিনা ও তার স্বামীর প্রতিক্রিয়া
অভিযুক্ত শাহিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তার স্বামী গোলজার রহমান সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা মাদ্রাসায় আসছেন কেন? যা পারেন করেন দেখি।” এরপর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
■ প্রশাসন ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া
ঘোড়াঘাট উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, “শিক্ষার্থী না হয়েও যদি সনদ ইস্যু করা হয়, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কালাইয়ের মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজি মোনারুল ইসলাম বলেন, “সংবাদ প্রকাশিত হলে বা লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা আক্তার জাহান বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভুয়া সনদে কেউ নিয়োগ পেলে, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
■ দুর্নীতির আড়ালে সম্পদের পাহাড়?
স্থানীয়রা জানান, মাদ্রাসার সুপার আব্দুল আলিম দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, বগুড়া ও জয়পুরহাটে তার নামে-বেনামে বহু সম্পদ গড়ে উঠেছে। কীভাবে একজন সাধারণ শিক্ষক অল্প সময়ে কোটিপতি বনে গেলেন—তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।
🔍 এই ঘটনা কেবল একটি আয়া পদের নিয়োগ নয়, বরং দেশের নিয়োগ ব্যবস্থার গভীর সংকট ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির নগ্ন চিত্র।
চোখ রাখুন দ্বিতীয় পর্বে: “দুর্নীতির পেছনে দুর্বৃত্তের ছায়া – সুপার আব্দুল আলিমের সম্পদের অনুসন্ধান।”