ইসরায়েলের লাগাতার হামলার পর নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ বাসভবন ছেড়ে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। প্রায় সবধরনের প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ বন্ধ করে তিনি এখন কেবল বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানি প্রশাসনের তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন—শীর্ষ নেতৃত্বে ক্ষয়ক্ষতি হলে যেন দেশজুড়ে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে জন্য খামেনি বিকল্প নেতৃত্বের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো—নিজে নিহত হলে দ্রুত উত্তরসূরি নিয়োগের লক্ষ্যে তিনি তিনজন জ্যেষ্ঠ নেতার নাম অনুমোদন দিয়েছেন।
৮৬ বছর বয়সী খামেনির আশঙ্কা, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তাঁকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। সে লক্ষ্যে, সর্বোচ্চ নেতাকে বেছে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা ‘মজলিশে খোবরেগান-ই-রাহবারি’কে আগেই বলে দিয়েছেন—তাঁর প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকেই নতুন নেতা নির্বাচন করতে হবে।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা
ইরান দাবি করেছে, ১৩ জুন শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলাকে তারা ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আগ্রাসন বলে মনে করছে। রাজধানী তেহরানসহ বহু এলাকায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা সে আট বছরের যুদ্ধেও হয়নি।
তবে এই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ইরান এখন পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের হাইফা শহরের তেল শোধনাগার, সামরিক ঘাঁটি, গোডাউন ও কৌশলগত স্থাপনাগুলোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও গুপ্তচর আতঙ্ক
ইরানি কর্তৃপক্ষ বলছে, যুদ্ধ এখন চলছে দুই ফ্রন্টে—একটি সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে, অন্যটি দেশের অভ্যন্তরে। ইসরায়েলের গুপ্তচর ও দোসররা বিদ্যুৎকেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, এমনকি বেসামরিক স্থাপনায়ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা স্বীকার করে ইরানি পার্লামেন্টের স্পিকারের উপদেষ্টা মাহদি মোহাম্মাদি বলেছেন, “আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ফাঁক ছিল। আমরা জানতেই পারিনি, শত্রুরা এত পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
অতএব, গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ এসেছে—সব কর্মকর্তাকে মোবাইলসহ যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে উচ্চ পর্যায়ের বাংকারে স্থানান্তরিত হয়েছেন। জনগণকেও সন্দেহজনক লোক ও গাড়ির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জাতীয় ঐক্য ও প্রতিরোধের বার্তা
আয়াতুল্লাহ খামেনি এই সংকটে এখন পর্যন্ত দু’টি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এই যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইরানি জনগণ মাথা নত করবে না, আত্মসমর্পণ করবে না।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের আহ্বান জানালেও, এই হামলা উল্টো জাতীয়তাবাদ ও ঐক্যবোধ উসকে দিয়েছে.
সমালোচক, অধিকারকর্মী, ক্রীড়াবিদ, চিকিৎসক, শিল্পী—সবাই সামাজিক মাধ্যমে একসাথে হামলার বিরোধিতা করছেন। এমনকি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নার্গিস মোহাম্মদিও সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে সরেও ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছেন।
ইরানের জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় সাঈদ এজাতোল্লাহি লিখেছেন, “সবসময় একমত না হলেও, ইরানের মাটি আমাদের রেড লাইন।”
জরুরি নিরাপত্তা পদক্ষেপ
ইরানের রাজধানী এখন অনেকটাই ফাঁকা। মহাসড়কগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, জনবহুল এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইন্টারনেট ও আন্তর্জাতিক ফোনকল আংশিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, কারণ এগুলো “শত্রুদের হাতে অস্ত্র হয়ে উঠছে”।
ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ঘোষণা দিয়েছে—যারা শত্রুপক্ষে কাজ করছেন, তারা যেন দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন; না হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।