শাহরিয়ার কবির, পাইকগাছা (খুলনা):
এক যুগ ধরে কপোতাক্ষ নদের তীরে একটি ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় বসবাস করছেন পাইকগাছার বৃদ্ধ সুখেন বিশ্বাস (৭০) ও তার স্ত্রী নমিতা বিশ্বাস। ঘর নেই, জমি নেই, নেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা—তবু বেঁচে আছেন। লড়ছেন। জীবনের সাথে, প্রকৃতির সাথে, সমাজের অবহেলার সাথে।
একসময় গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় তাদের ঘরবাড়ি ছিল। কিন্তু সর্বনাশা কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে ভেসে যায় সর্বস্ব। গৃহহীন হয়ে পড়েন তারা। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরের আবেদন করেও পাননি কোনো সহায়তা। শেষমেশ আশ্রয় নেন মাছ ধরার নৌকায়। সেই নৌকাই এখন তাদের ঘর, রান্নাঘর, শয়নকক্ষ—সবকিছু।
ভাঙন, দারিদ্র্য আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের সময় নদী থেকে নৌকা উড়ে গিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এরপর চড়া সুদে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আবার নতুন নৌকা কেনেন সুখেন। সেটি দিয়েই মাছ ধরেন, সংসার চালান। মাছ বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চাল-ডাল কেনেন, দুজনের ক্ষুধা মেটান।
তাদের একমাত্র ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী ঘরে। একটি মেয়ে নদীর চরে সরকারি জমিতে টিনের ঘর তুলে বাস করেন। মাঝে মাঝে সেই মেয়ের রান্না করা খাবারেই চলে সুখেন-নমিতার দিনরাত্রি।
নৌকার ছোট্ট এক কোণায় বাঁশের খুঁটির সঙ্গে চুলা বসিয়ে রান্না করেন নমিতা। রাতে গাছে রশি বেঁধে নৌকা স্থির রাখেন। ঝড়ের আশঙ্কা থাকলে খালে ঢুকে অপেক্ষা করেন। কখনো কখনো বাউল গান গেয়ে সান্ত্বনা খোঁজেন সুখেন।
সুখেন বিশ্বাস বলেন:
“ঘর নাই, জায়গা নাই। আম্ফানে নৌকা হারিয়ে আবার সুদে টাকা এনে নতুন নৌকা কিনেছি। এই নৌকা দিয়েই মাছ ধরি, খাই। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরের আবেদন করেছিলাম, পাইনি। সরকার যদি একটা ঘরের ব্যবস্থা করে, তাহলে অন্তত নিরাপদে বাঁচতে পারতাম।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন বলেন:
“বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যদি তিনি প্রকৃত ভূমিহীন হন এবং আবেদন করে থাকেন, আমরা অবশ্যই যাচাই করে ব্যবস্থা নেব। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর খালি থাকলে তাকে ঘর দেওয়া হবে।”
এই ভাসমান জীবন শুধু একটি দম্পতির কাহিনী নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের এক করুণ বাস্তবতা—যেখানে নদীভাঙন শুধু ঘর কেড়ে নেয় না, কেড়ে নেয় নিরাপত্তা, স্থিতি আর সম্মানের জীবন।