Shahjahan Ali Manon, Nilphamari District Representative:
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ১ নং রেলগুমটি সংলগ্ন রেললাইন পাড়ে গড়ে উঠা কামারপল্লী সারাবছরই কর্মমুখর থাকলেও কুরবানির মৌসুমে ভিন্ন মাত্রায় সরগরম হয়ে পড়ে। প্রতিবছরের মত এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদুল আজহা যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই জমে উঠেছে কামারপাড়া।
দিনরাত কানে আসে হাতুড়ি ও লোহা-পেটানো যন্ত্রপাতির টুং টাং শব্দ। কাজের ব্যস্ততায় এতটুকু গা জুড়ানোর সময় নেই। কার আগে কে কতটা যন্ত্র তৈরী করতে পারবে সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে গোটা এলাকা। এখানকার প্রায় ১০ টি কামারশালে শতাধিক মিস্ত্রি ও কর্মচারীর চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।

সোমবার (২ জুন) সরেজমিনে দেখা যায়, এই কামারপাড়ার একাধিক দোকানে অসংখ্য দা, বটি, চাপাতি, ছোরা-চাকুসহ বিভিন্ন কাটার যন্ত্রপাতির পসরা। আর পাশেই হাপড়ে আগুনের কুন্ডলীতে গরম করা হচ্ছে লোহা। সাথে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব। কেউ কেউ তৈরী যন্ত্রপাতির হাতল লাগানো ও ধার বা শান দেওয়ায় ব্যস্ত।

এরই মাঝে কুরবানির গোশত প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। গোশত কাটার সরঞ্জাম কিনতে আসা পার্শ্ববর্তী রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার চিকলী এলাকার তরিকুল ইসলাম বলেন, বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছুরি পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো টেকসই না। কামারদের তৈরি লোহার দা-বটি অনেক মজবুত এবং কাজেও ভালো হয়। তবে এবার দাম কিছুটা বেশি চাওয়া হচ্ছে।
আরেক ক্রেতা দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার রুমানা আক্তার বলেন, আমি সৈয়দপুরে কমিউনিটি নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়ি। ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ি থেকে জানানো হয়েছে বটি নেয়ার জন্য। তাই বটি নিতে এসেছি। এখানকার যন্ত্রপাতিগুলো অনেক ভালো। কারণ এখানে মানসম্পন্ন লোহা দিয়ে যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়। একই কথা জানান রুমানার সহপাঠী পঞ্চগড়ের মেয়ে লিমা। তিনিও একটা চাপাতি কিনেছেন বাড়ির জন্য।

সৈয়দপুর শহরের সুলতান নগর জামে মসজিদের ইমাম আবু সাইদ বলেন, কুরবানির আর বেশি দিন নেই। তাই আগে থেকেই দা, চাপাতিসহ দরকারি জিনিস কিনে নিচ্ছি। ঈদের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়, সময় বাঁচাতেই আগেভাগে এসেছি।
কারিগর ও বিক্রেতা মো. মামুন বলেন, একটা দা-বটি বানাতে অনেক খরচ হয়, কিন্তু সেই তুলনায় দাম ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখন বিদেশি দা-বটিও বাজারে ঢুকেছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের বিক্রিতে। তারপরও ঈদের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ডার পেয়েছি। এতদিন সেগুলো তৈরি ও সরবরাহ করেছি। এখন চলছে নিজের দোকানে বিক্রির জন্য।
তিনি আরও জানান, ঈদের আগের রাত পর্যন্ত চলবে এই ব্যস্ততা। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে রাত ২ টা পর্যন্ত কাজ করছেন তারা। মিস্ত্রি বা কারিগরদের মজুরি দৈনিক ৮ শ’ টাকা আর শ্রমিক তথা হামুরদারদের মজুরি সাড়ে ৬ শ’ টাকা। সেই সাথে হাতল লাগানো বা শান দেওয়ার মজুরি ৪-৫ শ’ টাকা। ঈদ উপলক্ষে বিক্রি ও লাভ দেখে কিছু ঈদ বোনাসও দেওয়া হবে।
রাজ ড্রাম কাটিং দোকানের মালিক রাজ বাবু বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও কৃষি যন্ত্রপাতি আধুনিক হওয়ায় আমাদের পণ্যের চাহিদা কমেছে। তার উপর কুরবানিকে ঘিরে লোহা ও কয়লার দাম বেড়েছে। খরচ বাড়লেও আমাদের আয় বাড়েনি। তারপরও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সামান্য লাভেই বিক্রি করছি।
তিনি জানান, পশু জবাই করার ছোরা সাইজ অনুযায়ী প্রতিটি ন্যুনতম ৫ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা, চাপাতি ও দা-বটি ৬-৭ শ’ টাকা কেজি আর চাকু ৩০ থেকে ১০০ টাকা পিস। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান প্রতি বছর ঈদে এখানে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি হয়। এবারও তেমনটাই আশা করছেন তারা।
সৈয়দপুর শহরের এই কামারপল্লীর মত উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের পানিশালা, বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের পোড়ারহাট, বাঙালীপুর ইউনিয়নের চৌমুহনী, কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের চওড়া বাজার এলাকাতেও বেশ কয়েকটি কামারশাল রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে সেখানেও কর্ম তৎপরতা বেড়েছে কর্মকারদের। শেষ মূহুর্তের ব্যস্ততায় কাটছে তাদের দিনরাত।