Monir Hossain, Benapole Correspondent:
যশোরের বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট এখন অনেকটাই ফাঁকা। নেই আগের মতো যাত্রীদের ভিড়, নেই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া মানুষের কোলাহল। দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধের ফলে বাংলাদেশ-ভারত যাত্রী পারাপারে চরম ভাটা পড়েছে।
এক সময় প্রতিদিন যেখানে ৭ থেকে ৯ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতেন, বর্তমানে তা নেমে এসেছে দেড় থেকে দুই হাজারে। এতে করে সরকার ভ্রমণ কর বাবদ রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা, আর বিপাকে পড়েছেন পরিবহন খাত, ব্যবসায়ী, মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
ভিসা জটিলতায় ধস নেমেছে যাত্রী চলাচলে
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বেনাপোল দিয়ে ভারতে গেছেন ২৩,৭২৪ জন এবং ফিরেছেন ২১,৫৫৬ জন যাত্রী। অথচ এই সংখ্যা আগের সময়ের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বাংলাদেশি যাত্রীর সংখ্যা কমলেও ভারতীয় যাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি ইব্রাহিম আহম্মেদ বলেন,
“স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৫,৫০০–৬,০০০ জন যাত্রী ভারতে যেতেন। এখন তা নেমে এসেছে গড়ে ১,৫০০-র নিচে। এদের অধিকাংশ মেডিকেল ভিসাধারী।”
রাজস্ব আয় কমেছে পাঁচগুণ
কাস্টমস সূত্র জানায়, যেখানে আগে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে ভ্রমণ কর বাবদ বছরে গড়ে ১৮২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো, সেখানে এখন প্রতি মাসে আয় হচ্ছে মাত্র ৩ কোটি টাকা।
পরিবহন খাতে ধস
যাত্রীর অভাবে একাধিক পরিবহন সংস্থা যেমন—দেশ ট্রাভেলস, গ্রিনলাইন, ফাইভ স্টার পরিবহন—আংশিক বা পুরো সেবা বন্ধ করেছে। স্টাফদের বেতন দিতে না পেরে অনেক পরিবহন কোম্পানিই সংকটে পড়েছে।
গ্রিনলাইন পরিবহনের ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ জানান,
“সামান্য কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এসি বাস চালালে তেলের খরচই উঠে না। বেতন না পেয়ে অনেকে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে।”
ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা
ভিসা সমস্যার কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমেও প্রভাব পড়েছে। পণ্যের গুণগত মান যাচাই করতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতে যেতে না পারায় এলসি কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন,
“বর্তমানে কেবল স্টুডেন্ট ও মেডিকেল ভিসায় সীমিত ভ্রমণ হচ্ছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় প্রভাব পড়ছে।”
ভিসা বন্ধ, ক্ষতির মুখে সাধারণ মানুষও
চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া রবিউল ইসলাম বলেন,
“মেডিকেল ভিসা পেলেও ভ্রমণ ভিসা নেই বললেই চলে। ভবিষ্যতে আবার ভিসা পাব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”
কমলা রানী নামের আরেক যাত্রী বলেন,
“আগে ইমিগ্রেশনে ভীড় থাকত, এখন নিরিবিলি। এমনকি পরের বার ভিসা পাওয়া যাবে কি না তা নিশ্চিত নই।”
মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী মশিয়ার রহমান বলেন,
“প্রতিদিন ১০ হাজারের মতো মানুষ যেত ভারত, এখন সেটি নেই। আমাদের ব্যবসাও ধসের মুখে।”
চলমান সংকটে সতর্ক প্রশাসন
বেনাপোল স্থলবন্দরের ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক মামুন কবীর তরফদার বলেন,
“ভিসা জটিলতা না কাটলে যাত্রী সংখ্যা আরও কমে যাবে। যাত্রী না থাকায় বন্দরের রাজস্ব আয়ও মারাত্মকভাবে কমেছে।”
বিশ্লেষণ:
ভারত সরকারের ভিসা নীতির কড়াকড়ি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখন শুধু সীমান্তের কোলাহলকেই স্তব্ধ করে দেয়নি, তা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ব্যবসা পর্যন্ত। দ্রুত কোনো কূটনৈতিক সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।