লন্ডনের অভিজাত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোট ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,২৮০ কোটি টাকা) মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও বাণিজ্যিক সম্পত্তি যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (National Crime Agency – NCA) সাময়িকভাবে জব্দ করেছে। এই সম্পত্তিগুলো বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী সাবেক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
NCA-এর বরাত দিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়া জানিয়েছে, সম্পত্তিগুলোর মালিকানা জটিল অফশোর কোম্পানি ও ট্রাস্টের মাধ্যমে গোপন রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধান এবং অর্থপাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি মনে করছে, এই সম্পদসমূহের উৎস অস্বচ্ছ এবং সেগুলোর পেছনে দুর্নীতির অর্থ থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ
জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, এসব সম্পত্তি কিনতে যে অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। লেনদেনের তথ্য ও ব্যাংকিং রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশ থেকে একাধিক স্তরের ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে এই অর্থ লন্ডনে প্রবাহিত হয়েছে, যার অনেকটাই বাংলাদেশ থেকে আসা অর্থের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে, এ ধরনের জব্দ করার ঘটনা প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালে একই ধরনের একটি অভিযানে আজারবাইজানের এক দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের লন্ডনের £৫০ মিলিয়নের সম্পদ জব্দ করেছিল NCA। তবে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক পরিবারের বিরুদ্ধে এই প্রথম এত বড় পরিসরে যুক্তরাজ্যে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
অভিযুক্ত কারা?
যদিও NCA এখনো অভিযুক্তদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি, তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই সম্পত্তিগুলোর পেছনে বাংলাদেশের এক সাবেক সামরিক শাসকের পরিবারের সদস্যদের নাম জড়িত থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টরা লন্ডনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা যায়।
এছাড়াও, এই পরিবারের বিরুদ্ধে অতীতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একাধিক অভিযোগ এনেছিল। যদিও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী হওয়ায় এসব অভিযোগের তদন্ত কার্যকরভাবে এগোয়নি।
ফাইন্যানশিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্ত, ৭.৭ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের দুটি সম্পত্তিতে জারিকৃত ফ্রিজিং আদেশে
ব্রিটেনের সম্মানজনক সংবাদমাধ্যম Financial Times জানিয়েছে, লন্ডনে যে £৯০ মিলিয়নের সম্পত্তি জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (NCA) সাময়িকভাবে ফ্রিজ করেছে, তার অন্তর্ভুক্ত দুটি সম্পত্তি শেখ রেহানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন এবং যুক্তরাজ্যের এমপি ও সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের মা।
এই দুটি সম্পত্তির মূল্য মোট £৭.৭ মিলিয়ন (প্রায় ১১০ কোটি টাকা), এবং প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ রেহানা এই সম্পত্তিগুলোর একটিতে বসবাস করেছেন। তবে রিপোর্টে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মালিক কিনা বা অর্থের উৎস কী, সে বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
ফাইন্যানশিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সম্পত্তির ফ্রিজিং আদেশ জারির পেছনে যুক্তরাজ্যের ‘Unexplained Wealth Orders (UWO)’ আইন কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ, সম্পদের উৎস ও মালিকানা যদি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করা না যায়, তাহলে তা সাময়িকভাবে জব্দ করা হয় এবং মালিক পক্ষকে বৈধতা প্রমাণ করতে হয়।
এখনো পর্যন্ত শেখ রেহানা বা টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
এই তথ্য যুক্ত হওয়ায় ঘটনাটির রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে, কারণ এটি সরাসরি বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবারের একজন সদস্যকে যুক্ত করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও আলোচিত একটি বিষয় হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি অনানুষ্ঠানিক সূত্রে জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং NCA-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে প্রস্তুত। যদি যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে প্রমাণাদিসহ সহযোগিতা চাওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ইঙ্গিত
NCA জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করছে। এই ধরনের জব্দ করা সম্পদ সম্পর্কে বলা হয়, যদি বৈধ উৎস প্রমাণ করা না যায়, তাহলে সেগুলোকে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী, Unexplained Wealth Orders (UWO) বা ‘অব্যাখ্যেয় সম্পদ আদেশ’-এর আওতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হয় যে, জব্দ করা সম্পদের অর্থ বৈধ উৎস থেকে এসেছে।
নৈতিক বার্তা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বার্তা। এটি শুধু রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক নজিরই নয়, বরং প্রবাসে বসবাসকারী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্যও এক ধরনের সতর্কবার্তা। পশ্চিমা বিশ্ব ধীরে ধীরে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিদেশি সম্পদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে যেসব অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য এক ধরনের ‘রক্তপাত’ তৈরি করছে। আর এসব অর্থপাচারকারীরা আন্তর্জাতিক দুর্নীতির চক্রের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যার মাধ্যমে দেশীয় সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছে অবাধে।
ফাঁস হচ্ছে আরও প্রভাবশালীদের নাম
যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (National Crime Agency – NCA) সম্প্রতি লন্ডনের £৯০ মিলিয়ন (প্রায় ১,২৮০ কোটি টাকা) মূল্যের একাধিক সম্পত্তি সাময়িকভাবে ফ্রিজ করেছে, যেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তাঁর পরিবারের সম্পৃক্ততা
এই ঘটনায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম হচ্ছে সালমান এফ রহমান, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন এবং দেশের ভেতরে তাঁকে সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে দেখা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যদিও তিনি বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছেন।
ব্রিটিশ পত্রিকা The Guardian ও দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন Transparency International-এর যৌথ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার মালিকানাধীন সম্পত্তিগুলোও এই অনুসন্ধানের আওতায় পড়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও আত্মীয়দের মালিকানাধীন সম্পত্তির মোট মূল্য ছিল প্রায় £৪০০ মিলিয়ন (প্রায় ৫,৭০০ কোটি টাকা)।
ফ্রিজ হওয়া সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে Gresham Gardens-এর এক বাড়ি
NCA-এর তালিকায় ফ্রিজ করা সম্পত্তির মধ্যে উত্তর লন্ডনের Gresham Gardens-এ অবস্থিত একটি বিলাসবহুল বাড়িও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এলাকাটি লন্ডনের অভিজাত এবং উচ্চবিত্তদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এই বাড়িটি মূলত একটি অফশোর ট্রাস্টের মাধ্যমে রেজিস্টার করা হয়েছে, এবং যার অর্থের উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা এখনো দেওয়া হয়নি।
শেখ রেহানার নামেও এসেছে অভিযোগ
এর আগে Financial Times জানায়, ফ্রিজ হওয়া £৯০ মিলিয়ন মূল্যের সম্পত্তির মধ্যে দুইটি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে সম্পৃক্ত। শেখ রেহানা লন্ডনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন এবং তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের এমপি ও সাবেক সিটি মিনিস্টার। ফাইন্যানশিয়াল টাইমস জানায়, ৭.৭ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সেই দুটি সম্পত্তির একটিতে শেখ রেহানা বসবাস করতেন।
বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সতর্ক বার্তা ও বাংলাদেশের নীরবতা
NCA-এর এই পদক্ষেপ যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন। তারা বলছে, যুক্তরাজ্যকে কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের অর্থ পাচারের গন্তব্য হতে দেওয়া হবে না। ‘Unexplained Wealth Orders (UWO)’ আইনের আওতায় মালিক পক্ষকে এখন এসব সম্পদের বৈধ উৎস প্রমাণ করতে হবে, অন্যথায় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার বা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র বলছে, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজন হলে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর ভাবমূর্তির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। একইসাথে এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির।