রাশেদ মানিক
প্রতি বছর ১ মে দিনটি বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক, সংগ্রামের স্মৃতি এবং ঐক্যের চিহ্ন। কিন্তু একটি ব্যতিক্রমী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র—যেখানে এই মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়, বরং শ্রমিকদের দিবস হিসেবে তারা পালন করে সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার। প্রশ্ন হলো, বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত দেশটি কেন মে মাসে এই দিনটি পালন করে না?
১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হাজার হাজার শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা ধর্মঘটের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ৪ মে ‘হেইমার্কেট স্কয়ার’-এ, যেখানে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি বোমা নিক্ষেপ করলে পুলিশ ও শ্রমিক উভয়পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সেই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত মোড় নেয়। বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে দোষারোপ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও তাদের অপরাধ কখনো প্রমাণিত হয়নি।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মে মাসের শ্রমিক আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা ও শিল্পপতিদের কাছে হয়ে ওঠে ‘অশান্তি’ ও ‘বিপ্লবের’ প্রতীক। ১৮৯৪ সালে যখন দেশে আরেকটি বড় শ্রমিক ধর্মঘট (Pullman Strike) শুরু হয়, তখন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড শ্রমিকদের শান্ত করতে চাইলেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ পথ বেছে নিলেন। তিনি ১ মে নয়, সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারকে “Labor Day” হিসেবে ঘোষণা করলেন। কারণ, এই দিনটি হেইমার্কেট ট্র্যাজেডির সঙ্গে যুক্ত নয় এবং সামাজিক উত্তেজনাও সৃষ্টির সম্ভাবনা কম।
ফলে ‘লেবার ডে’ আমেরিকায় হয়ে উঠল একটি অবকাশ, উৎসব, ছুটির দিন—যেখানে শ্রমিকের আন্দোলনের ইতিহাস অনুপস্থিত। এই দিনটি দোকানের ডিসকাউন্ট, পিকনিক আর গ্রীষ্মের শেষ উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপ, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে ১ মে এখনো শ্রমিক আন্দোলনের সংগ্রামী চেতনা বহন করে। বিভিন্ন দেশে এই দিনে মিছিল হয়, ব্যানার ধরে মানুষ রাস্তায় নামে, আলোচনা হয় অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান শুধু একটি ভিন্ন তারিখ বেছে নেওয়া নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এটি একধরনের রাজনৈতিক অবস্থান—যা বিদ্রোহকে ভুলে যেতে বলে, আর পরিবর্তে শ্রমিকের অবদানকে শ্রদ্ধা জানায় এক নির্ভরযোগ্য ও নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাপটে।
তবুও মে দিবস বিশ্বকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকের ঘাম, চোখের জল, এবং সংগ্রাম ছাড়া সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতাগুলো চাপা দিলেও তার সত্য আজও বহমান।
রাশেদ মানিক
লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা