কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ কাণ্ড (১৯৯১): একটি কালো অধ্যায়
পটভূমি:
কাশ্মীর উপত্যকা ১৯৮৯ সালের পর থেকে ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সাক্ষী হতে শুরু করে। এই সময়ে ভারত সরকার এই বিদ্রোহ দমন করতে জম্মু ও কাশ্মীরে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তখন থেকেই ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। এরই মধ্যে ঘটে যায় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালের কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ কাণ্ড, যা কাশ্মীর সংঘাতের ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক ও বিতর্কিত ঘটনা।
এই ঘটনাটি দেখায়, কিভাবে নারীর দেহকে একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত করা হয়। এটি শুধুই যৌনতা নয়—এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের অস্ত্র। ধর্ষণের মাধ্যমে গোটা সমাজকে ভয় দেখানো হয়, নারীর সম্মান ভেঙে চূর্ণ করা হয়, যাতে সমাজে নীরবতা তৈরি হয়।
Anwar Murad
ঘটনাবলী:
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, ভারতীয় সেনাবাহিনী কুপওয়াড়া জেলার দুটি গ্রাম—কুনান O পোশপোরা—তে রাতের আঁধারে একটি “কর্ডন অ্যান্ড সার্চ” অপারেশন চালায়। তাদের দাবি ছিল, ওই এলাকায় জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছে।
- সন্ধ্যার পরপরই, সেনা সদস্যরা গ্রামের পুরুষদের বাইরে নিয়ে যায় “জিজ্ঞাসাবাদের” জন্য।
- রাতের বেলায়, ঘরে থাকা নারীদের (যাদের মধ্যে ৮ বছরের কিশোরী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ছিলেন) ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
- অনেক নারী জানান, তাদের পরিবারের সামনেই নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং সন্তানদের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল।
- ধর্ষণের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতন, ঘরবাড়ি লুট এবং অবমাননাকর আচরণের কথাও বলা হয়।
১৯৮৯ সালের পর থেকে কাশ্মীর ভারতবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ভারত সরকার এই বিদ্রোহ দমন করতে কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন করে। সংঘাত যত তীব্র হয়, তত বাড়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি—বিশেষত নারীদের।এই সময় সেনাবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে ‘কর্ডন অ্যান্ড সার্চ’ অপারেশনের নামে হানা দেয়। তেমনই এক অভিযানে কুপওয়াড়ার কুনান ও পোশপোরা গ্রামে ঘটে যায় নারকীয় গণধর্ষণের ঘটনা।
অভিযোগ ও সংখ্যাগত পার্থক্য:
- সরকারি তথ্যে বলা হয়, ২৩ জন নারী অভিযোগ করেছিলেন। তবে গ্রামবাসী এবং মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ৫০ থেকে ১০০ জন নারী এই ঘটনার শিকার হন।
- ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই সামাজিক লজ্জা, ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রকাশ্যে আসেননি।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত:
ঘটনার পর ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
- জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুয়াফফার আহমেদ জান (Muzaffar Jan) একটি রিপোর্ট পেশ করেন, যাতে তিনি গণধর্ষণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেন না এবং আরও তদন্তের পরামর্শ দেন।
- এরপর প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে সাংবাদিক বিজয়ানাথন নারায়ণন-এর একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা ঘটনাকে “প্রোপাগান্ডা” বলে আখ্যা দেয় এবং অভিযোগকে “ভিত্তিহীন” বলে বাতিল করে দেয়।
- অনেকেই এই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কারণ প্রাথমিক তদন্তে সাক্ষীদের বয়ান উপেক্ষা করা হয় এবং নারীদের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, Amnesty International, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনাটিকে গণধর্ষণ এবং রাষ্ট্রের দায়মুক্তির একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছে।
- কাশ্মীরভিত্তিক অধিকার সংগঠনগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবি করে আসছে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
- এই ঘটনার ফলে কাশ্মীরি নারীদের মধ্যে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়।
- অনেক পরিবার সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নারীরা বিষণ্ণতা, আতঙ্ক এবং PTSD-তে ভুগতে থাকেন।
- অনেক ভুক্তভোগী আজও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত।
পুনরুজ্জীবন ও প্রতিবাদ:
২০১১-১২ সালের দিকে এই মামলাটি আবার আলোচনায় আসে যখন একদল সাহসী কাশ্মীরি নারী, একে “গণধর্ষণের রাজনীতি” হিসেবে অভিহিত করে, পুনরায় মামলা খোলার জন্য আবেদন করেন।
২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়:
- 📘 “Do You Remember Kunan Poshpora?” — এটি কাশ্মীরি নারী লেখক ও সমাজকর্মীদের লেখা একটি বই। এতে survivors-দের বয়ান, সাক্ষাৎকার, এবং ঘটনাটি নিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকার বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।
আজকের বাস্তবতা:
৩ দশকেরও বেশি সময় কেটে গেলেও, কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ কাণ্ডে এখনও কোনো বিচার হয়নি। এ ঘটনা কেবল কাশ্মীরেই নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র-সহিংসতা, লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন ও দায়মুক্তির প্রশ্নে একটি প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
প্রথমে ভয়ে এবং লজ্জায় অনেকেই চুপ থাকলেও, ধীরে ধীরে কিছু সাহসী নারী প্রতিবাদে মুখর হন। তারা জানিয়ে দেন—“We will not be silenced.”
২০১১-১৩ সালের দিকে, একদল কাশ্মীরি নারী ও আইনজীবী আবারও মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন। ফলে, এই ঘটনা আবারও উঠে আসে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনামে।
প্রকাশিত হয়: 📘 “Do You Remember Kunan Poshpora?” — লেখিকা নাইলাহ আলতাফ, হাব্বা খাতুন প্রমুখের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই বই survivors-দের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
Conclusion:
কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ কাণ্ড ভারতের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতের নাম। এটি শুধুমাত্র একটি গণধর্ষণের ঘটনা নয়, বরং সেটি কিভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তি ও দায়মুক্তির ছত্রছায়ায় সংঘটিত হতে পারে—তার একটি করুণ দলিল।
কোনো সংঘাত কেবল গুলির শব্দেই চিহ্নিত হয় না। অনেক সময় তার প্রতিধ্বনি সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয় নারীর শরীরে। ভারতের কাশ্মীর উপত্যকায় ১৯৯১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটে যাওয়া কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ কাণ্ড তারই এক নির্মম প্রমাণ। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি দুঃস্বপ্ন নয়, বরং রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়মুক্তি এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত নারীদের সংগ্রামের একটি দলিল।