সউদ আব্দুল্লাহ
কালাই(জয়পুরহাট) প্রতিনিধি:
এবারের আলু চাষ যেন ছিল কৃষকদের কাছে এক সোনালী স্বপ্ন। আবহাওয়া ও জমির অনুকূল পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনুপস্থিতি এবং আগের বছরের ভালো বাজারদরের প্রেক্ষিতে জয়পুরহাট জেলার কৃষকরা আলু চাষে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়েছিলেন। ফলনও হয়েছিল আশানুরূপ, বাম্পার ফলন। কিন্তু সেই সোনালী স্বপ্ন আজ যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। হিমাগারে জায়গা নেই, বাজারে নেই আলুর দাম, ফলে কৃষক বাধ্য হচ্ছেন সেই আলু প্রাণীখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে।

জয়পুরহাট জেলায় এ বছর ৪৩,৪৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন প্রায় ৯ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু জেলায় হিমাগার রয়েছে মাত্র ১৯টি, যেগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা এক লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন মাত্র। এতে করে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু রয়ে যাচ্ছে হিমাগারের বাইরে।ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়েছেন ঘরে,মাঠে, এমনকি বাড়ির আঙ্গিনায় আলু সংরক্ষণ করতে,যা গরমে দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কালাই উপজেলার আকলাপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ জানান,চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি।ফলন ভালো হলেও বাজারে বিক্রি করলে খরচের অর্ধেকও উঠছে না। হিমাগারে জায়গা না পেয়ে ঘরে রেখেছি, কিন্তু গরমে পঁচে যাচ্ছে।এখন কেটে গরুকে খাওয়াচ্ছি,না হলে সবই নষ্ট হয়ে যাবে।”
হাতিয়র গ্রামের জিয়াউর রহমান বলেন,আমি ৩০০টি চটের বস্তায় আলু রেখেছি। উৎপাদন খরচ কেজিতে ২২ টাকা অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়। কেজিতে ১০ টাকা লোকসান হচ্ছে!”
বড়াইল গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা আক্তার। তার পাঁচটি গরুর নিত্যদিনের খাবারে পরিণত হয়েছে সেদ্ধ আলু। তবে মাঝে মাঝে সময় না পেলে কাঁচা আলুই গরুকে খেতে দেন তিনি।রোজিনার স্বামী মফিদুল ইসলাম বলেন,এবার ৪ বিঘা জমিতে স্টিক জাতের আলু আবাদ করেছি। খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। বাজারে আলুর দাম কম হওয়ায় গরুর বিকল্প খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছি।
উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের কৃষক আজিজার রহমান জানান,৫৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। হিমাগারে অতিরিক্ত স্লিপ না পাওয়ায় আলু বাড়িতে রেখেছি। এখনো ৬৫০ বস্তা আলু বিক্রি হয়নি, এরমধ্যে ১৩৪ বস্তা পচে গেছে।যা বাকি আছে,তার দাম কেজিতে মাত্র ২ টাকা!”
উপজেলার পুনট বাজারে দেশি লাল পাকরী আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮-৯ টাকা কেজি। অথচ উৎপাদন খরচ কেজিতে ১৫-২২ টাকা। এতে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে কৃষকদের ঘাটতি গুনতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ী শামীম হোসেন জানিয়েছেন, তিনি ১২.৫ টাকা কেজি দরে আলু কিনে বাইপাইল এলাকায় বিক্রি করছেন,কিন্তু সেই দাম কৃষকের ক্ষতির মাত্রাও পুষিয়ে দিতে পারছে না।
উপজেলার সবগ্রামেই এখন গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে আলু।কেউ সেদ্ধ করে,কেউ কাঁচা আলুই খাওয়াচ্ছেন গরুকে। কিন্তু প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন,এতে গরুর স্বাস্থ্যের চরম ক্ষতি হচ্ছে।উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মনিরুজ্জামান জানান,আলু শর্করা জাতীয় খাবার।বেশি খাওয়ালে পেটফাঁপা এবং বিষক্রিয়া হতে পারে,বিশেষ করে কাঁচা আলুতে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ দাবি করছেন। বাজারে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ,অতিরিক্ত হিমাগার নির্মাণ এবং বিকল্প বাজার ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কৃষকদের বাঁচানো সম্ভব নয়। তারা আশঙ্কা করছেন,এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন চাষিরা।
কালাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অরুণ চন্দ্র রায় বলেন, গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষকরা বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু হিমাগারে স্থান সংকট ও অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারকে জানিয়েছি, দ্রুত সমাধানের প্রত্যাশা করছি।