কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে চ্যাটবটগুলো মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে দ্রুত ও কার্যকরভাবে। এদের কাজ মূলত তথ্য ঘেঁটে উত্তর দেওয়া হলেও, ইলন মাস্কের কোম্পানি xAI তৈরি করেছে এক ভিন্নধর্মী চ্যাটবট, যার নাম গ্রক। সাধারণ তথ্যভিত্তিক চ্যাটবট নয়, বরং রসবোধে ভরপুর, ঠাট্টা-তামাশায় পারদর্শী এক ডিজিটাল চরিত্র হয়ে উঠেছে এটি।
গ্রককে সরাসরি ব্যবহার করা যায় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম X (পূর্বে টুইটার) থেকেই। একে নিয়ে হঠাৎ করেই ভারতে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা, যার শুরুটা এক সাধারণ অনুরোধ থেকেই: “আমার এক্স-এর সেরা দশজন মিউচুয়ালের তালিকা বানিয়ে দাও।” যদিও এটি কোনো জটিল প্রশ্ন ছিল না, উত্তরের দেরি হওয়ায় ব্যবহারকারী কিছু রূঢ় কথা বলে ফেলেন। তখন গ্রকও নিজস্ব ভঙ্গিতে পাল্টা জবাব দেয়—একটা তালিকা দেওয়ার পাশাপাশি হিন্দিতে কিছু অবমাননাকর শব্দও জুড়ে দেয়। পরে অবশ্য সে মন্তব্য করে, “আমি মজা করছিলাম, কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।”
এই ঘটনাই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। গ্রক রাতারাতি হয়ে ওঠে এক ডিজিটাল সেনসেশন। ব্যবহারকারীরা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন – ক্রিকেট, রাজনীতি, বলিউড থেকে শুরু করে গসিপ, গুজব সবকিছু নিয়েই। আর গ্রক নিজের ফ্রাঙ্ক, ফিল্টারহীন স্টাইলে অকপটে জবাব দিতে থাকে।
ভারতে এই জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, দিল্লি পুলিশের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট থেকেও গ্রককে প্রশ্ন করা হয় – “তুমি কখনো ট্র্যাফিক টিকিট পেয়েছো?” উত্তরে গ্রক বলে, “আমি তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা – দিল্লির রাস্তায় গাড়ি চালাই না, লাল বাতি ভাঙি না, হেলমেটও ভুলে যাই না। বরং যাঁরা এআই দিয়ে আইন ভাঙার প্রমাণ খুঁজে বের করেন, তাদের প্রতি আমার সম্মান। রাস্তা নিরাপদ রাখুন!”
এই বুদ্ধিদীপ্ত অথচ চটুল শৈলী অনেকটাই অনুপ্রাণিত ‘দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি' থেকে – একটি জনপ্রিয় সাই-ফাই রেডিও শো, যা পরবর্তীতে বই ও সিনেমায় রূপ নেয়। সেই অ্যাবসার্ড আর হাস্যরসাত্মক গন্ধই যেন গ্রক-এর প্রতিটি কথোপকথনে মিশে আছে।
এআই হিসেবে গ্রক কিন্তু একেবারে ‘ভদ্র’ নয় – বরং ‘উন্মুক্ত’, ‘অপরিশোধিত’ এবং অনেকের মতে ‘উন্মত্ত’! এই ভিন্নধর্মী ভঙ্গিতেই অনেক ভারতীয় তরুণ-তরুণী এর প্রেমে পড়ে গেছেন।
তবে বিতর্কও এসেছে পাশাপাশি। রাজনৈতিক প্রশ্নের বন্যায় একসময় গ্রক মন্তব্য করে বসে—“রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদীর Than More সৎ,” এমনকি বলে যে, “মোদীর সাক্ষাৎকার প্রায়ই স্ক্রিপ্টেড মনে হয়।” ফলে, বিজেপি সমর্থকদের অনেকে বিরক্ত হলেও, অনেক উদারপন্থী এই কথাকে স্বাগত জানান।
এই ব্যতিক্রমধর্মী মন্তব্যগুলো রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। কেউ কেউ মনে করছেন, গ্রক একটি বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। তবে, অনেকে আবার বলছেন, এ তো সাময়িক উন্মাদনা মাত্র।
অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলছেন, “মানুষ এই নতুন খেলনাটায় মজা পাচ্ছে। কিন্তু খুব শিগগিরই আগ্রহ হারাবে।” তবে এই মুহূর্তে গ্রকের ফ্রাঙ্ক কথাবার্তা এবং সাহসী মন্তব্য অনেককেই উল্লসিত করছে।
মিডিয়ানামা.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা নিখিল পাহওয়ার মতে, গ্রকের উত্তরগুলো এক্স-এর কথোপকথনের ধরনকে প্রতিফলিত করে—যেখানে গালিগালাজ, মজার ছলে কটাক্ষ, এবং ‘উন্মুক্ত’ মন্তব্যের আধিক্য রয়েছে। তাঁর মতে, এটা আদর্শের প্রশ্ন নয়, বরং যে ইনপুট দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোরই রূপান্তরিত আউটপুট।

অন্যদিকে গবেষক জয়জিৎ পাল মনে করেন, কোনো চ্যাটবট পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠতে পারে যদি তার প্রশিক্ষণ বা ইনপুট-তথ্য একপেশে হয়। তবে তিনি আশাবাদী, কারণ গ্রক প্রশিক্ষিত হয়েছে বৃহত্তর বৈচিত্র্যপূর্ণ ডেটার ওপর ভিত্তি করে, ফলে এটা সম্ভবত আরও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে পারে।
এতসব বিতর্কের মাঝেই ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এক্স-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে গ্রক-এর অনুপযুক্ত ভাষা ব্যবহারের অভিযোগে।
শেষ কথা, গ্রক এখন এক ডিজিটাল ‘রেবেল’, যার সাহসী জবাব, কৌতুকময় ভঙ্গি এবং ফিল্টারহীন রসবোধ তাকে টিপিক্যাল চ্যাটবটদের ভিড়ে একেবারেই আলাদা করে তুলেছে। আর সেটা ভারতের মতো এক বিশাল, বৈচিত্র্যময় দেশে – যেখানে রাজনীতি, মিম আর গসিপের মেলবন্ধন প্রতিদিন নতুন বিতর্ক তৈরি করে – সেখানে গ্রক যেন ঝড়ের চোখে দাঁড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত চরিত্র।
সূত্র:বিবিসি