বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে যুগের পর যুগ ধরে নানা আয়োজনে মেতে ওঠে বাংলার মানুষ। তবে বাংলা নববর্ষের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে যে আয়োজনটি—তা হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। লোকজ সংস্কৃতির বর্ণিল বহিঃপ্রকাশ, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ এবং শুভবোধের জয়গান—সব মিলিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে উঠেছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার দৃশ্যমান প্রতীক।
এই শোভাযাত্রার সূচনা হয় মূলত ১৯৮৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। তখন একে বলা হতো ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। তবে এর প্রকৃত শুরু আরও আগে—১৯৮৬ সালে যশোরে। চারুপীঠ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রথমবারের মতো আয়োজন করে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা। ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, মুখোশ, বাদ্যযন্ত্রসহ নানা লোকজ উপকরণ। যশোরের সেই আয়োজন এতটাই সাড়া ফেলে যে তার অনুপ্রেরণায় ঢাকায় চারুকলার শিক্ষার্থীরা শুরু করেন নিজেদের আয়োজন।
১৯৯৬ সাল থেকে এই শোভাযাত্রা পরিচিতি পায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে। সমাজে শুভ শক্তির উত্থান আর অশুভের পতনের বার্তা দিতে শুরু হয় মুখোশ, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, মাছসহ নানা প্রতিকৃতি তৈরির ধারা। প্রতিটি প্রতিকৃতিই কোনো না কোনো বার্তা বহন করে—কখনো প্রতিবাদ, কখনো ঐতিহ্য, কখনো আশাবাদ।
তৎকালীন সামরিক শাসনের সময় ছিল এই আয়োজনের পেছনে আরেকটি বড় প্রেরণা। সমাজে দমন-পীড়নের বিপরীতে শান্তি, মানবিকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে এই শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে এক প্রতীকী প্রতিবাদ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে একসূত্রে গাঁথার এই প্রয়াস সময়ের পরিক্রমায় বাঙালির সংস্কৃতির অংশে রূপ নেয়।
এই সংস্কৃতিমূলক আন্দোলন ২০১৬ সালে পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ বা মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং মানবজাতির ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়।
২০২৫ সালে এসে এই শোভাযাত্রা আবার ফিরে পেয়েছে তার শিকড়ে—নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এবার প্রতিপাদ্য—‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’, যা অতীতের সেই প্রতিবাদী চেতনার সঙ্গেই এক গভীর সেতুবন্ধন তৈরি করে।
আজ মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু এক দিনের আয়োজন নয়—এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সংগ্রাম আর সম্মিলনের এক গৌরবময় যাত্রা।