ইরান, চীন ও রাশিয়া তাদের বার্ষিক নৌ-মহড়া মেরিন সিকিউরিটি বেল্ট ২০২৫ শুরু করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত মহাসাগরে সামরিক কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই মহড়া এমন সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছেন এবং ন্যাটোসহ ঐতিহ্যবাহী জোটগুলোর প্রতি তার প্রতিশ্রুতি দুর্বল করেছেন।
মহড়ার ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও উদ্দেশ্য
এই যৌথ মহড়াটি ওমান উপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা একটি কৌশলগত জলপথ। এই এলাকাটি পারস্য উপসাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ৩০% পরিবহন হয়। মহড়াটির লক্ষ্য হচ্ছে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জলদস্যু দমন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম এবং বহুপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
ইরানি নৌবাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল মোস্তফা তাহেরি বলেছেন,
“আমরা আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই এবং বহুপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে এই মহড়া পরিচালনা করছি। এটি প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জলপথ রক্ষার প্রতিশ্রুতিও বহন করে।“
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে,
“আমরা মুক্ত ও নিরাপদ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিশ্চিত করতে কাজ করছি এবং এই মহড়া আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও মজবুত করবে।“
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও নিশ্চিত করেছে যে,
“এই মহড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে এবং এটি অঞ্চলজুড়ে সামরিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।“
ট্রাম্পের নীতি এবং পশ্চিমা জোটের দুর্বলতা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে, যার ফলে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তিনি ন্যাটো জোট সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন এবং ইউরোপের দেশগুলোর ওপর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের চাপ বাড়িয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্তও তার নতুন কৌশলের অংশ।
ওয়াশিংটন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সামরিক বিশেষজ্ঞ রবার্ট ম্যাকগ্রেগর বলেছেন,
“ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি পশ্চিমা জোটে দুর্বলতা তৈরি করছে, আর তা থেকে লাভবান হচ্ছে রাশিয়া ও চীন। তারা দ্রুত একটি নতুন প্রতিরক্ষা জোট গড়ে তুলছে।“
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জেমস ডরসি মন্তব্য করেছেন,
“এই মহড়া প্রমাণ করে যে ইরান, চীন ও রাশিয়া তাদের সামরিক সম্পর্ক আরও গভীর করছে, যা পশ্চিমা শক্তির জন্য একটি বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হতে পারে।“
ইরান, চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত উদ্দেশ্য
বিশ্লেষকদের মতে, এই যৌথ মহড়া আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
ইরান: যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ও প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি করতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে।
চীন: দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চাইছে।
রাশিয়া: মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি নতুন প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক জোট তৈরির চেষ্টা করছে।
পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই মহড়ার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা নিচ্ছে। মার্কিন নৌবাহিনী ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক টহল বাড়িয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সও এই অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত থাকলেও, ইরান, রাশিয়া ও চীন তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে। ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে।
এই মহড়া কেবল একটি সামরিক মহড়া নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে—পশ্চিমের সামরিক আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এবং বিশ্ব দ্রুত একাধিক মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।