মঙ্গলগ্রহ, আমাদের সৌরজগতের অন্যতম রহস্যময় গ্রহ, যা নিয়ে বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। মহাকাশযান, রোবট ল্যান্ডার এবং অর্বিটারগুলোকে দিয়ে মঙ্গলের পৃষ্ঠের সঠিক চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এসব অভিযানে একাধিক বার প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, একসময় মঙ্গলে বিশাল হ্রদ এবং নদী ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে মঙ্গলে তরল পানি ছিল। তবে, এই পানি কোথায় গেছে, কেন মঙ্গলগ্রহ এখন পরবর্তীতে শুকনো এবং মরূদৃশ্য হয়ে উঠেছে, এই প্রশ্ন এখনও পুরোপুরি সমাধান হয়নি। এখন, একটি নতুন গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে যা মঙ্গলের লাল ধুলোর রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করছে, এবং এটি এই ধারণাকেই আরো দৃঢ় করছে যে, একসময় মঙ্গলে পানি ছিল।
গবেষণার ফলাফল: মরিচা এবং পানি
সম্প্রতি Nature Communications জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মঙ্গলের লাল রঙ আসলে আয়রন অক্সাইড বা মরিচার কারণে। মরিচা সাধারণত তৈরি হয় যখন আয়রন বা লোহা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে, যার ফলে এটি লাল রঙে পরিণত হয়। পৃথিবীতে, এই প্রক্রিয়া সাধারণত বৃষ্টির মধ্যে ঘটে, তবে মঙ্গলে বৃষ্টি নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো, মঙ্গলের মরিচা কিভাবে তৈরি হল?
গবেষণাটি প্রমাণ করেছে যে, মরিচা তৈরির জন্য যা প্রয়োজন তা ছিল মঙ্গলে একসময় তরল পানি। যখন পানি ছিল, তখন অক্সিজেনের সাথে আয়রন রিঅ্যাক্ট করে মরিচার সৃষ্টি করেছিল। তবে, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতেন না যে, মঙ্গলের মরিচা কি পৃথিবীর মরিচার মতোই ছিল, এবং তা কতটা আর্দ্র ছিল। এই নতুন গবেষণায়, বিজ্ঞানীরা এটি প্রমাণ করেছেন যে, মঙ্গলের মরিচা পৃথিবীর মরিচার মতোই এবং এতে যথেষ্ট পানি রয়েছে, যা মঙ্গলের অতীতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে।
কলিন উইলসনের বক্তব্য
গবেষণার মধ্যে অন্যতম অংশীদার, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির ExoMars Trace Gas Orbiter and Mars Express এর প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট কলিন উইলসন, বলেন: “মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত শুষ্ক, তবে এই গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, মঙ্গলের মরিচা পৃথিবীর মরিচার মতো অনেক বেশি আর্দ্র। আমরা জানি যে, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে পানি বাষ্পের পরিমাণ মাত্র কয়েক শতাংশ, যার কারণে এটি শুষ্ক মরিচা হবে। তবে, আমাদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মঙ্গলের মরিচা পৃথিবীর মরিচার মতো আর্দ্র এবং এতে যথেষ্ট পানি রয়েছে।”
উইলসনের মতে, এই গবেষণা বিজ্ঞানীদের মঙ্গলের মরিচার উৎস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, মরিচার সৃষ্টি তখনই হয়েছে যখন মঙ্গলে তরল পানি উপস্থিত ছিল, এবং সেই পানি কোনোভাবে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে মরিচা তৈরি করেছিল।
মঙ্গলে বৃষ্টিপাতের অভাব
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মঙ্গলে বৃষ্টিপাত নেই। পৃথিবীতে যখন মরিচা তৈরি হয়, বৃষ্টিপাত তার ধুলাকে ধুয়ে ফেলে, তবে মঙ্গলে তেমন কিছু হয় না। মঙ্গলে বৃষ্টির অভাবের কারণে, মরিচা তৈরির প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে সারা গ্রহে ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে মঙ্গলের পৃষ্ঠে প্রায় একধরনের মরিচা অবস্থায় রয়েছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অ্যাডোমাস ভ্যালানটিনাস, যিনি এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন, তিনি বলেন, “মঙ্গলে বৃষ্টিপাত নেই, তাই সমস্ত ধুলা বায়ু দ্বারা সারা গ্রহে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কোনো বৃষ্টি এটি ধুয়ে ফেলে না। পৃথিবীতে যেমন আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির ধুলা কখনো কখনো ইউরোপে পৌঁছে, কিন্তু সেখানে বৃষ্টি পড়লে তা পরিষ্কার হয়ে যায়, মঙ্গলে তেমন কিছু ঘটেনি।”
এই তথ্য আরো একবার প্রমাণ করেছে যে, মঙ্গলে একসময় জলবায়ু ছিল যা এখন নেই। তবে, সেই সময়ের মরিচা এখনো মঙ্গলের পৃষ্ঠে দৃশ্যমান। এই আবিষ্কার আমাদের মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে আরো গভীর ধারণা দিচ্ছে এবং বিজ্ঞানীদের সেই প্রাচীন সময়ের পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কে জানতে সহায়ক হচ্ছে।
গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ
এই গবেষণার ফলে, বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের অতীত সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেছেন। তারা জানেন যে, মঙ্গলে একসময় পানি ছিল, এবং সেই পানি মরিচা তৈরিতে সহায়ক ছিল। তবে, একে শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই নয়, বরং একটি বৃহত্তর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে, যার মাধ্যমে মঙ্গলের পরিবেশ এবং তার জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ে, মঙ্গলের পৃষ্ঠে প্রাণ থাকার উপযুক্ত পরিবেশ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে নানা কারণে সে পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে মঙ্গল আজ এক শুষ্ক, মরূদৃশ্য গ্রহে পরিণত হয়েছে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, এই নতুন আবিষ্কার মঙ্গলের অতীত নিয়ে আরো বড় প্রশ্নের উত্তর দিতে সহায়ক হবে, বিশেষ করে সেখানে যদি কোনো সময়ে প্রাণের অস্তিত্ব থেকেও থাকে, তবে সেটা কেমন ছিল। এই গবেষণা আরও বড় মহাকাশ অনুসন্ধানের পথ খুলে দিতে পারে, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে সক্ষম হবেন।
মঙ্গলের লাল ধুলোর কারণের উপর এই গবেষণা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে এবং একে ধরে বিজ্ঞানীরা এখন মঙ্গলের প্রাচীন পরিবেশ এবং সেখানে একসময় ছিল এমন পানি সম্পর্কিত নানা তথ্য আরো বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করতে সক্ষম হবেন। এটি আমাদের আরও গভীরভাবে মঙ্গলের ইতিহাস এবং সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে জানতে সহায়ক হবে। বিজ্ঞানীরা আশা করেন, এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে মঙ্গলে জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কিত আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করতে সাহায্য করবে, এবং এর মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহের অতীতের সঠিক চিত্রটি আমরা পেতে পারব।