জামিউল ইসলাম তুরান, শান্তিগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) :
সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম শত্রুমর্দন। এখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুব্রত দেবনাথ রামাচরণ—যিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও মনেপ্রাণে গীতিকার। ছদ্মনাম ‘রামাচরণ’ ব্যবহার করে তিনি লিখে চলেছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অসংখ্য গান, যার একটি সম্প্রতি বাজানো হয়েছে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে।
করোনাকালেই গানের শুরু
করোনা মহামারির সময় যখন চারদিকে নীরবতা, তখন শান্তিগঞ্জ উদীচীর শিল্পীদের ফেসবুক লাইভে গান পরিবেশন চলছিল। একদিন রামাচরণের সহকর্মী রিংকু সেই গান শুনে গলা মেলাচ্ছিলেন। মজা করে রামাচরণ তখন বলেছিলেন, “পুরনো গান গাচ্ছিস কেন? আমি নতুন গান লিখে দেই, গাইতে পারবি?” সেখান থেকেই যাত্রা শুরু।
তবে গীতিকারের যাত্রা আসলে করোনার দুই বছর আগেই, একটি ধামাইল গান দিয়ে শুরু হয়েছিল। শখের বসেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন, এখন তা একপ্রকার মনের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘পুরা জগৎ জানে’—ইত্যাদিতে বাজা গান
২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর, বিটিভির ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় রামাচরণের লেখা “পুরা জগৎ জানে, পুরা জগৎ মানে” গানটি। গানটি পরিবেশন করেন জনপ্রিয় শিল্পী সেলিম চৌধুরী ও তোসিবা বেগম। সেলিম চৌধুরী প্রথমে ভালো একটি ডুয়েট গানের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখনও রামাচরণ জানতেন না এটি ‘ইত্যাদি’তে যাবে।
কোটি মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া গান
রামাচরণের লেখা গান ইতিমধ্যে গেয়েছেন ডলি সায়ন্তনী, গামছা পলাশ, সালমা, বন্যা তালুকদার, রাজু মণ্ডল ও আয়েশা জেবিন দীপাসহ বহু জনপ্রিয় শিল্পী। তাঁর লেখা “প্রেমের মোহনায়” গানটি ইউটিউব ও ফেসবুকে মিলিয়ে ইতোমধ্যে ২ কোটির বেশি ভিউ অর্জন করেছে।
হাওরের সন্তান, প্রযুক্তির শক্তি
নিজেকে গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও রামাচরণ বলেন, “আমি সংগীতজ্ঞ নই। তবে আমি বিশ্বাস করি, শব্দে যদি সুর বসে, সেটা হৃদয়ে পৌঁছে যায়।” তিনি বলেন, “আমি হাওরে থাকি, ঢাকায় থাকলে হয়তো গানটাই পেশা বানাতাম। এখন মোবাইল, ফেসবুক, ইউটিউবের কারণে গান অনেক দূর পৌঁছানো সম্ভব।”
গান লেখার অনুপ্রেরণায় তিনি উল্লেখ করেন লোকসংগীতের কিংবদন্তি শাহ আবদুল করিমকে। পাশাপাশি গীতিকার বুলবুল আনাম O হারুনুর রশিদের দিকনির্দেশনাকেও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
সিনেমায় গান লেখার স্বপ্ন
রামাচরণের ভাষায়, “সিনেমার জন্য গান লেখার প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আমি ভবিষ্যতে সিনেমা, ওয়েব সিরিজ কিংবা জাতীয় দিবস উপলক্ষে গান লিখতে চাই।” তিনি আরও বলেন, এখন অনেক তরুণ-তরুণী তার কাছে গান লেখার কৌশল বা প্রচারণার পরামর্শ নিতে আসেন।
গানের নেশা, কিন্তু ক্ষতিকর নয়
রামাচরণের ভাষায়—“গান এমন এক নেশা, যা মানুষকে শান্তি দেয়। মদ-গাঁজার মতো নয়, এই নেশায় হারিয়ে নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।”
বর্তমানে ব্যবসা ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত গান লিখতে পারেন না, তবে তাঁর ইচ্ছে, “জীবন একটু স্থির হলে আবার নিয়মিত গান লিখবো।”
সরকারের প্রতি অনুরোধ: সংস্কৃতির জন্য পরিবেশ গড়ুন
রামাচরণ মনে করেন, “দেশে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ দরকার। হাওরাঞ্চলের অনেক তরুণ প্রতিভাবান হলেও সুযোগের অভাবে তারা পিছিয়ে পড়ে। প্রশাসন বা সরকার এদের পাশে দাঁড়ালে আরও অনেক রামাচরণ উঠে আসবে।”
প্রশাসনের কণ্ঠে আশ্বাস
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা বলেন, “হাওরের মতো প্রান্তিক এলাকা থেকেও কেউ যদি জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরেন, সেটা অবশ্যই গর্বের বিষয়। রামাচরণের মতো প্রতিভাবানদের পাশে থাকাই আমাদের দায়িত্ব।”