Satyajit Das (Moulvibazar Correspondent):
বাংলাদেশের প্রান্তিক কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এক জনগোষ্ঠী মনিপুরী সম্প্রদায়। তাদেরই অন্যতম আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব ‘লাই হরাউবা’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে। উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও গ্রামে অবস্থিত মনিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সে। আগামী ২৩-২৫ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী এই উৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে।
এই উপলক্ষে আয়োজক কমিটি কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব ওইমান লানথৈই,উপস্থিত ছিলেন কমিটির আহ্বায়ক শ্যামল ইবুংহাল ও সদস্য রবি কিরণ রাজেশ।
‘লাই হরাউবা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ;- দেবতাদের আনন্দে ভরপুর হওয়া। এটি মনিপুরী ধর্মবিশ্বাসে সৃষ্টিতত্ত্ব, দৈবশক্তি, কসমোলজি এবং মানবজীবনের আধ্যাত্মিক অবস্থান নিয়ে এক দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এই উৎসবে প্রকাশ পায় মনিপুরী সমাজের প্রাচীন জীবনদর্শন ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা। মূলত এটি কোনো একক ধর্মীয় আচারে সীমাবদ্ধ নয়,বরং এটি এক আত্মিক ও সাংস্কৃতিক নৃত্যগাথা,যেখানে রয়েছে:
– লাইপৌ (পবিত্র মন্ত্রপাঠ),
– মাইবী জাগোই (প্রাচীন নারীনৃত্য),
– ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ও সংগীত,
– এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নাটকীয়তা ও দেবতা-মহিমা প্রকাশ।
এই উদযাপন কেবল স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে নয়, বরং ইউনেস্কো ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ ফান্ড-এর সহায়তায় পরিচালিত একটি দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় হচ্ছে। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে রয়েছে—
– বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর,
– আইজিসিসি (IGCC),
– কনসোর্টিয়াম অব ICHpedia,
– সাধনা,
– পৌরৈ অপোকপা মরুপ প্রভৃতি।
বাংলাদেশে মনিপুরীদের বসবাস মূলত মৌলভীবাজার,সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে। তারা মূলত হিন্দু বৈষ্ণব ধর্ম ও প্রাক-হিন্দু স্থানীয় দেব-উপাসনার একটি সংমিশ্রিত রূপ পালন করে।
তাদের সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
– রাসনৃত্য ও মাইবী জাগোই,
– পুঙবাদ্য ও মৃদঙ্গ,
– মণিপুরী পোশাক (ফানেক,ইনাফি),
– এবং মনিপুরী ভাষায় পারফর্মেন্স ও সাহিত্যচর্চা।
মনিপুরী সংস্কৃতি সৌন্দর্য,আধ্যাত্মিকতা এবং শৃঙ্খলিত নান্দনিকতায় অতুলনীয়। তারা নিজেদের জীবন ও উৎসবকে ধর্মীয় অনুশাসন এবং প্রাকৃতিক ছন্দে বেঁধে রাখে।
আয়োজকরা জানান,‘লাই হরাউবা’ উৎসবটি সকল ধর্ম,বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। তারা চান, এই উৎসব হোক সম্প্রীতির মিলনমেলা,যেখানে মানুষ শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীকে দেখবে না, বরং বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐক্যকে অনুভব করবে।
মনিপুরী ‘লাই হরাউবা’ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় বা লোকজানুষ্ঠানিকতা নয়— এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে একটি জীবন্ত ইতিহাস,একটি নৃতাত্ত্বিক সেতুবন্ধন,যেখানে অতীত ও বর্তমানের মিলন ঘটে ঐতিহ্যের সুরে।