Joypurhat District Representative
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল ভূমি অফিসের তহসীলদারের আদায় করা টাকা যায় অন্যান্য টেবিলে। টাকা ছাড়া হয়না নামজারী, দরকষাকষি ছাড়া নিতে পারেনা খাজনার রশীদ ও অন্যান্য সেবা। ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইলের মুক্তি মেলে না। নামজারি ফাইলে ঘুষের রেট বেশি। এসি ল্যান্ডের জন্য মোটা অংকের ভাগ রেখে দিয়ে অন্যরা ফাইলের ম্যারিট ও মক্কেল বুঝে টাকা হাতিয়ে নেন।
নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহসীলদারদের) বিরুদ্ধে। একাধিক মহল থেকে সতর্ক করার পর কোন প্রতিকার মিলছে না ক্ষেতলাল ভূমি অফিসে।
দালালরা ধারণা দিয়েছেন, কোনো কোনো মাসে লাখ লাখ টাকার ওপরে ঘুষ লেনদেন হয়। শুধু ভূমি অফিসের দালালি করে এখানে অনেকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। অথচ ওপরে সবাই নিজেকে সৎ ও সাহসী অফিসার বলে দাবি করেন। কিন্তু সন্ধ্যা হলে ঠিকই ঘুষের খাতা কল করে কড়ায়-গণ্ডায় নিজের পাওনা বুঝে নেয়া হয়। দৈনিক পাঞ্জেরীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘুষ লেনদেনের ভয়াবহ সব চিত্র। নমুনা হিসেবে কয়েকটি ঘটনার অডিও-ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষিত আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা পাঁচটি ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাদের বেপরোয়া অনিয়মের কারনে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। বড়াইল ভূমি অফিসে খাজনা আদায়ের সময় পাঁচশত টাকার রশিদ দিয়ে অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মামুদপুর ইউনিয়ন তহসীলদারকে এমন অভিযোগে একাধিক বার শোকজ করেও কোন পরির্বতন হয়নি। বড়তারা ইউনিয়ন ভূমি কর্তা ভূয়া জাল দলিলে নামজারী অভিযোগও আছে। সাংবাদিকদের তোপের মুখে তা বাতিল করতে বাধ্য হয় এসিল্যান্ড।
তহসীলদার মুমিনুল হক গত বছর এ উপজেলায় যোগদান করেন। এর পর থেকে বেড়ে যায় ভূমি অফিসে দালালের দৌরাত্ম। অল্প সময়ের মধ্যে দলিল লেখক (মোহরা) ও নকল নবিসদের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে তোলে তাদের হাতে করেন এসব অনিয়মের লেনদেন। মুমিনুল হক কয়েক মাস ক্ষেতলাল সদর ও বড়াইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সপ্তাহে দুইদিন বসতেন। তিনি ওই অফিসে নিয়ম বর্হিভূতভাবে একজন ব্যক্তিগত সহকারী রেখেছেন। ওই ব্যক্তিগত সহকারীকে (ভূমি মন্ত্রনালয়ের) গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) আদায় ও অনলাইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম করতে দেখাগেছে।
গোপন সূত্রে জানাগেছে, উর্দ্ধোতন কর্তার যোগসাজসে ওই ব্যক্তিগত সহকারীর দ্বারা খাজনা আদায়ের নামে রশীদের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কাজ করেন। সরেজমিনে তদন্ত ও নোটিশ জারি ছাড়ায় নালিশী সম্পত্তিরও নামজারীর প্রস্তাব পাস করে। টাকা না দিলে নামজারী আবেদনকারীর নামের আঁকার ওকার ভুল ধরে বাতিল করে। এতে সাধারণ ভূমি মালিক’রা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে তার দ্বারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দলিল লেখক জানান, তাদের গোপন ভিডিও রেকর্ড দৈনিক পাঞ্জেরীর হাতে সংরক্ষিত আছে। সার্ভেয়ার ও তহসীলদার মুমিনুল হক আসার পর থেকে কাজের রেট বেড়ে গেছে। মিস কেসের সিরিয়াল ও তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় ১-১০ হাজার, নামজারীর তদন্ত প্রতিবেদন বাবদ দিতে হয় এক হাজার টাকা। মিস কেসে শুনানীর জন্য যোগাযোগ না করলে দীর্ঘ তারিখ জুড়ে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার নির্দিষ্ট চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল নিয়ে মিস কেসের শুনানী ও প্রতিবেদন দাখিল করে।
উপজেলার পশ্চিম সরাইল দাসড়া মৌজার হাজী হাড়ী সরদার ওয়াকফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী ভুক্তভোগী ওয়ারেছুল মজিদ কদর বলেন, জনৈক নবিউল ইসলাম চৌধুরী একখন্ড রেওয়াজ দলিল মূলে গত ২ জানুয়ারীতে ওই ওয়াকফ এস্টেটের তফসিলভুক্ত ১৮ শতক সম্পত্তির নামজারী আবেদন করে। উভয় পক্ষে শুনানী অন্তে নামজারী আবেদনটি না মঞ্জুর (বাতিল) করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিন্নাতুল আরা।
অভিযুক্ত তহসীলদার মুমিনুল হক যোগদানেরপর একই ব্যক্তি ওই সম্পত্তি গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিঃ তারিখে পূনরায় নামজারী আবেদন করেন। ওই তহশিলদার ও সার্ভেয়ার কবির উদ্দিনের যোগসাজশে নোটিশ জারী গোপন রেখে সরেজমিনে পরির্দশন ছাড়াই নামজারী আবেদন (খারিজ) প্রদান করেন এসিল্যান্ড জিন্নাতুল আরা। ওই ওয়াকফ এস্টেটের তফসীলভুক্ত সম্পত্তি আদালতে বিচারাধীন মোকদ্দমার যাবতীয় কাগজপত্র ও বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের স্মারকে চিঠি নথিযুক্ত করার পরও ওই কাগজপত্র গোপন রেখে নামজারী প্রদান করেন।
গত ১৫ অক্টোবর খারিজ বাতিল চেয়ে আবেদন করে, অজানা কারনে খারিজ বাতিলের কোন অগ্রগতি হয়না। তখন ডিসি অফিস ও সাংবাদিকদের অভিযোগ করে তাদের চাপে নামজারী বাতিল করে ।
ভুক্তভোগী সাজাদুর রহমান শাহিন বলেন, গত ২৪ অক্টোবর শাখারুঞ্জ মৌজার দুইটি খতিয়ানের ৫৯ শতক ধানী জমির খাজনা দেওয়ার জন্য বড়াইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাই। তহশিলদার মুমিনুল হক ব্যস্ততা দেখিয়ে তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলে খাজনার রশিদ নিতে বলে। ওই সহকারী সাত সতের হিসাব দিয়ে প্রথমে ৮হাজার টাকা চায়। পরে দরকষাকষি করে ৪হাজার টাকায় মিট হয়। ওই টাকা নিয়ে মাত্র ৫শত ২০ টাকার দুটি অনলাইন রশিদ দেয়। ওই ঘটনা পাঞ্জেরী প্রতিনিধিকে জানায় তিনি তহসীলদার মুমিনুলকে মোবাইল ফোনে জানালে ওই তহসীলদার আমাকে ডেকে সমোদয় টাকা ফেরত দেয়।
ভুক্তভোগী ভূমি মালিক আলহাজ্ব আঃ গফুর বলেন, আমার বয়স ৭০ বছর একটি খারিজ বিষয়ে ক্ষেতলাল সদর ভূমি অফিসে তসিলদার মুমিনের কাছে জানতে চেয়েছি। উনি রেগেগিয়ে আমাকে বলে তুমি বড়াইলের বিষয় ক্ষেতলাল অফিসের জানতে আসলেন কেন? এই অপরাধে অফিসের ভিতরে অনেক লোকজনের সামনে লাঞ্ছিত করে পড়নের পাঞ্জাবি ছিড়ে ফেলে ঘাড় ধক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয়। ইউএনও, এসিল্যান্ড কে অভিযোগ করেও কোন ব্যবস্থা করেনি।
তহসিলদার মুমিনুল হক বলেন, ভাই ভূমি অফিসে যারা চাকরী করে তাদের গায়ে গন্ধ লেগেই থাকে যা পারেন করেন।
এবিষয়ে সার্ভেয়ার কবির উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ, কেউ প্রমান করতে পারবে না! কেউ যেন সেনাবাহিনীকে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দিয়েছিলেন। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো তদন্ত করে দেখুক। পাঞ্জেরীর অনুসন্ধানে সার্ভেয়ার ও তহসিলদার মুমিনুলের অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের কিছু প্রামান্য চিত্র দেখানো হয়। এরপর তিনি নড়েচরে বসে এবং এবিষয়ে আর কোন কথা বলতে রাজি হয়নি।
ক্ষেতলাল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিনাতুল আরা এমন অভিযোগ আমি প্রথম শুনলাম। লিখিত অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জয়পুরহাট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাঃ সবুর আলীকে ক্ষেতলাল উপজেলা ভূমি অফিসের নানা অনিয়মের ভিডিও চিত্র, কলরের্কড, মোবাইলে ধারণকৃত স্থির চিত্র দেখানো হলে তিনি বলেন, এমন প্রমানসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।