বহুদিনের কথার লড়াই শেষে অবশেষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুই দেশ। এতে উদ্বেগে পড়েছে দুই দেশের ব্যবসায়ী মহল।
বাংলাদেশ সরকার গত মাসে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। দেশীয় শিল্পকে সস্তা আমদানির প্রভাবে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় ঢাকা।
এর কয়েক দিন আগেই ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা হঠাৎ স্থগিত করে দেয়। এর আওতায় বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বন্দর ও বিমানবন্দর হয়ে তৃতীয় দেশে রপ্তানি করার সুযোগ ছিল। দিল্লির দাবি, তাদের বন্দর ও রুটগুলোতে ‘জট’ তৈরি হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে হাসিনা ভারতে নির্বাসিত, আর শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে দেশে ফেরত আনার দাবি জানানো হয়েছে। হাসিনা এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও দিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ ভারতের পক্ষ থেকে অতীতেও তোলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, এসব ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা সাধারণ অপরাধের অংশ।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক খাতে এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি। বিশেষত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, বড় ধাক্কা খাচ্ছে। ২০২৪ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশই স্থলপথে এসেছে। স্থলপথ বন্ধ হওয়ায় খরচ ও সময় বেড়ে গেছে।
এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, ভারতীয় রুট ব্যবহার করে পশ্চিমা বাজারে পৌঁছাতে মাত্র এক সপ্তাহ লাগত, যা এখন সমুদ্রপথে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিচ্ছে।
বাংলাদেশের সীমিত বিমান পরিবহনক্ষমতা এবং রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবও সরাসরি সমস্যা তৈরি করছে।
অনেকেই মনে করছেন, অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফর এবং ভারত সম্পর্কে তাঁর কিছু মন্তব্যই ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইউনূস বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের “সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ইঙ্গিত দেন, ওই অঞ্চল ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণ’ হয়ে উঠতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর; মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অঞ্চলটি চীন ও বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। দিল্লির আশঙ্কা, আঞ্চলিক উত্তেজনার সময় এই করিডোর টার্গেট হতে পারে।
বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইউনূসের বক্তব্য আঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নয়নের দিকেই ইঙ্গিত করছিল। তবে তাঁর চীন সফরের সময় তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের আগ্রহকে স্বাগত জানানো এবং প্রকল্পটির অবস্থান শিলিগুড়ির কাছে হওয়ায় ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি ভারত ভিসা দেওয়ার হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে। এতে বাংলাদেশিদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে। প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ মানুষ ভারত সফরে যেতেন, এখন তা দৈনিক ৮০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বলেন, “আমরা হাসিনাকে সহজে তুলে দিতে পারি না। তাঁর কী পরিণতি হতে পারে, তা আমাদের জানা আছে। ভারতীয় জনমতও সেটি সমর্থন করবে না।”
এদিকে, ভারতীয় পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশের পোশাক আমদানিতে স্থলপথে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাণিজ্যে বাড়তি প্রতিবন্ধকতা উভয়ের জন্য আত্মঘাতী হবে।
ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাংলাদেশে এখন একটি দৃঢ় মতামত তৈরি হচ্ছে যে, আগের সরকার ভারতকে যে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছিল, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।”
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ এখনো বন্দর ও রুট ব্যবহার করতে দিচ্ছে, তবে প্রত্যাশিত পরিমাণে পরিবহন হচ্ছে না।
এই টানাপোড়েনের মাঝে বাংলাদেশ- পাকিস্তান সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। গত ১৫ বছরে এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি—পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ—ঢাকা সফর করেন। যদিও কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারত- পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির জেরে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত হয়।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক শ্যাম শরণ বলেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগে আপত্তি নেই, কিন্তু যদি তা ভারতের বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে।”
জনগণের মধ্যেও দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে এবং ভারতীয় মিডিয়ার বিরুদ্ধে অতিরঞ্জন ও পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে অভিযোগ বাড়ছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দুই পক্ষ যদি উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তবে তা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।