সাগর-রুনি হত্যা: এক যুগ পেরিয়েও কেন নেই বিচারের আলো?
বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজে সবচেয়ে আলোচিত এবং বেদনাদায়ক একটি হত্যাকাণ্ডের নাম—সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। এরপর কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। কিন্তু আজও তাদের হত্যার বিচার হয়নি। অপরাধীরা রয়ে গেছে অধরা। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করেও সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে গঠিত টাস্কফোর্স একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যাতে উঠে এসেছে নতুন কিছু তথ্য, কিন্তু তা কি যথেষ্ট?
১. হত্যার ভয়াবহতা ও ঘটনাস্থলের বিবরণ
তদন্তে জানা গেছে, সাগর ও রুনিকে হত্যা করা হয় রান্নাঘরে থাকা ধারালো ছুরি ও বঁটি দিয়ে। তাদের শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা বলে দেয় এই হত্যাকাণ্ড কতোটা নিষ্ঠুর ছিল। ভিসেরা রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের শরীরে কোনো ধরনের চেতনানাশক বা বিষক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, তারা সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় রাত ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে।
২. কল্পনাতীত নিরাপত্তা ব্যর্থতা
ঘটনাস্থল ছিল একটি সুরক্ষিত ভবন। সেদিন কোনো জোরপূর্বক প্রবেশের চিহ্ন মেলেনি। তাহলে প্রশ্ন আসে, কীভাবে হত্যাকারীরা বাসায় প্রবেশ করল? পরিচিত কেউ কি ছিল? নাকি আগেই বাসায় ঢুকে লুকিয়ে ছিল? ভবনের নিরাপত্তাকর্মীর বক্তব্য, তিনি কাউকে সন্দেহজনকভাবে আসতে দেখেননি। অথচ একটি পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে কেউ নিরবে বেরিয়ে গেল—এটা কি গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ব্যর্থতা নয়?
৩. ডিএনএ রিপোর্ট ও অপরাধীর অনুপস্থিত ছায়া
সাম্প্রতিক টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় কমপক্ষে দুইজন। তদন্তে পাওয়া গেছে অপরিচিত ডিএনএ, কিন্তু তা যথেষ্ট পরিষ্কার নয় বলে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক যুগে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, অপরাধীদের ডিএনএ শনাক্তে এমন অস্পষ্টতা বিস্ময়কর। এতে প্রশ্ন উঠছে, অপরাধীরা কি কোনো প্রভাবশালী মহলের ছায়ায় ছিল?
৪. তদন্তের গড়িমসি: একের পর এক ব্যর্থতা
ঘটনার পর প্রথমে তদন্ত শুরু করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। পরে দায়িত্ব যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)-এর হাতে। এরপর তদন্ত হস্তান্তর করা হয় র্যাব-এর কাছে। দীর্ঘ এই সময়ে ৮ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়। আদালত বারবার তদন্ত প্রতিবেদন চাইলেও আশানুরূপ অগ্রগতি দেখাতে পারেনি কোনো সংস্থা। এ পর্যন্ত ৮৩ বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল স্থগিত বা অসম্পূর্ণ।
৫. পেশাগত দ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহ, না অন্য কিছু?
হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল পেশাগত শত্রুতার ফল। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি পারিবারিক কলহের জের। কিন্তু তদন্তে এসব ধারনার কোনো সত্যতা মেলেনি। সাগর ও রুনি ছিলেন দেশীয় গণমাধ্যমের শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত, এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট বা অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না এমনও নয়। ফলে এটি কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
৬. সন্তান মেঘ—নীরব সাক্ষী
হত্যার সময় তাদের একমাত্র সন্তান মেঘ একই ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। তখন তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। ঘটনাটির মানসিক অভিঘাত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সে। এই ঘটনায় তার ভবিষ্যৎ, তার শৈশব—সবই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মেঘ ছিল নীরব সাক্ষী, কিন্তু তার শিশু মন কী ধারণ করেছিল, তা কেউ জানে না।
৭. সাংবাদিক সমাজের হতাশা ও প্রতিবাদ
বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ শুরু থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে। বহুবার বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মরণসভা হয়েছে। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির সামনে সবকিছু ব্যর্থ হয়েছে। এটি কেবল একটি সাংবাদিক দম্পতির মৃত্যু নয়, এটি একটি পেশার নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্ন।
৮. বিচারহীনতার যে খেসারত
সাগর-রুনির হত্যার বিচার না হওয়া মানে কেবল একটি মামলার স্থবিরতা নয়, বরং এটি আমাদের বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা। এটি প্রমাণ করে, ক্ষমতার ছায়ায় থেকে অপরাধীরা চাইলে আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে। এবং এই বার্তা নতুন অপরাধীদের উসকে দেয়।
এক দশক পরও যখন একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের কোনো দৃশ্যমান বিচার হয় না, তখন তা শুধু নিহতদের নয়, গোটা জাতির জন্য অপমানজনক। সাংবাদিকতা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র—তিনটি স্তম্ভই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ। এখনো সময় আছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলেই নতুনভাবে এবং আন্তরিকভাবে তদন্ত করে প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। নতুবা ‘সাগর-রুনি’ কেবল একটি হত্যা নয়, হয়ে থাকবে একটি রাষ্ট্রের লজ্জার প্রতীক হিসেবে।