বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলা বন্দর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে চীনের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বহুগুণে বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় কোম্পানি ‘ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড’ (IPGL) প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর চীন নতুন অংশীদার হিসেবে যুক্ত হয়। ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ চীনের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (CCCC)-এর মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ভারতের সরে যাওয়া ও চীনের অংশগ্রহণের পটভূমি
২০২৩ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতীয় কোম্পানি IPGL মংলা বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের বন্দর, নৌপরিবহন ও জলপথ মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালমংলা বন্দরের সম্প্রসারণে ভারতের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছিলেন। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি আর এগোয়নি।
এই অবস্থায়, সরকার বিকল্প বিনিয়োগকারী খুঁজতে চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং চীন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের উন্নয়ন ও বিনিয়োগে সম্মত হয়। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা মনে করছেন, চীনের বিনিয়োগ মংলা বন্দরের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রকল্পের মূল বৈশিষ্ট্য ও বাজেট
এই প্রকল্পের আওতায় মংলা বন্দরকে একটি স্বয়ংক্রিয়, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক ‘গ্রিন পোর্ট’-এ রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চীনের সহযোগিতায় বন্দরের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটবে, যা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা আরও বাড়াবে।
✅ প্রকল্পের মোট বাজেট: ৪,০৬৮ কোটি ২২ লাখ ৭২ হাজার টাকা
✅ নির্মাণ শুরু: ২০২৫ সালের জানুয়ারি
✅ নির্মাণ শেষ: ২০২৮ সালের ডিসেম্বর
মূল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড
- ৩৬৮ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি নতুন কন্টেইনার জেটি নির্মাণ
- লোডেড ও আনলোডেড কন্টেইনারের জন্য বিশেষ ইয়ার্ড স্থাপন
- সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সিস্টেম চালু
- পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি
- ভবিষ্যতে বন্দরটিকে কোল্ড পোর্টে রূপান্তরের পরিকল্পনা
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এই উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠতে পারে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, মংলা বন্দরের উন্নয়ন বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমের গতিশীলতা বাড়াবে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য, বিশেষ করে আম ও কাঁঠালসহ অন্যান্য পণ্য সরাসরি চীনে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—
✅ বন্দরটির আধুনিকায়নের ফলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
✅ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবেন।
✅ বাণিজ্যিক খরচ কমে যাবে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য লাভজনক হবে।
✅ বন্দরটির আধুনিকায়ন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাকাত হোসেন বলেন,
🗨️ “আমরা অনন্তকাল বসে থাকতে পারি না। প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের পর অর্থ ছাড় দ্রুত হবে বলে আশা করছি।”
ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক
মংলা বন্দরের উন্নয়নে চীনের সম্পৃক্ততা ও ভারতের সরে যাওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বন্দর ও নৌপথে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে এই ক্ষেত্রে চীন সরাসরি যুক্ত হওয়ায় এশিয়ার দুই পরাশক্তির মধ্যে একটি নতুন প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
- ভারত, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকবে.
- বাংলাদেশকে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, যাতে উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকে.
- বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনে বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে.
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে মংলা বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বন্দরটির চূড়ান্ত রূপান্তর হলে এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর বন্দর হিসেবে গড়ে উঠবে।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন:
🗨️ “এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের দৃশ্যপট বদলে যাবে। এটি শুধুমাত্র একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, এটি দেশের অর্থনীতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।”
নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ Said,
🗨️ “বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ। তবে একইসঙ্গে চীনের বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়েও ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বাধীনতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।”
মংলা বন্দরের আধুনিকায়নে চীনের বিনিয়োগ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যা আমদানি-রপ্তানির গতি বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে, ভারতের সরে যাওয়া ও চীনের সম্পৃক্ততা ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল নিতে হবে।
📌 আপনার মতামত কী? চীনের এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে বলে মনে করেন?