দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল স্বৈরাচারী সরকারের শেষ ছয় বছরে। এই সময়ে ধর্ষণ, অপহরণ, এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে। এই ছয় বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ হাজারের বেশি নারী, এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু।
ধর্ষণের বীভৎস চিত্র
একটি স্বায়ত্তশাসিত মানবাধিকার সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ২০ জনের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র নথিভুক্ত মামলাগুলোর ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে, তবে বাস্তবে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচার পাননি। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা সামাজিক লজ্জার ভয়ে কিংবা হুমকির কারণে মামলা করতে পারেননি।
মানবাধিকার সংস্থা “সেভ আওয়ার সিস্টারস” এর নির্বাহী পরিচালক জানান, “ধর্ষণের ঘটনা শুধু যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, বরং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭,৫০০ নারীকে।”
অপহরণের হিমশৈল
নারী ও শিশুদের অপহরণও স্বৈরাচারী সরকারের আমলে ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। অপহরণের ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে, আবার অনেককে পাচার করে দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অপহরণের মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মানবপাচার ও যৌন শোষণ। নিখোঁজদের মধ্যে অনেককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, অনেককে দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিচারের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপরাধগুলোর বিচার না হওয়াটাই ছিল স্বৈরাচারী শাসনের সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করেছে, রাজনৈতিক চাপের কারণে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার কারণেই ধর্ষণ ও অপহরণ বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত প্রভাবিত হয়েছে বা তদন্তই হয়নি।”
সমাজের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ করণীয়
নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, এই নৃশংস অপরাধগুলোর বিচার করা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করা অত্যন্ত জরুরি। তারা নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ, দোষীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনাগুলোর বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
নারী অধিকার কর্মী নাসরিন সুলতানা বলেন, “আমরা চাই, যারা এই জঘন্য অপরাধ করেছে তারা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। এই বিচার না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়বে।”
দেশের ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসনের সময়কাল ছিল নৃশংস অপরাধের কালো অধ্যায়। ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন ও বিচারহীনতার এই যুগের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতেও নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কার্যকরীতা এবং নারী সুরক্ষায় সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই ধরনের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়।