ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, গাজাকে পুনর্দখল ও শাসনের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি করছে ইসরায়েলি সরকার, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সমর্থন পাচ্ছে। এই পরিকল্পনা ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি সরকার দ্বারা পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং এটি গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ও মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
গাজার জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা
নতুন পরিকল্পনার আওতায় গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দাকে আল মাওয়াসি নামে ছোট একটি এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আল মাওয়াসি একটি উপকূলীয় এলাকা, যা বর্তমানে ইসরায়েলি প্রশাসন ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে বর্ণনা করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে গাজার ফিলিস্তিনিরা মানবেতর অবস্থায় পড়বে এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হতে পারে।
ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি নেতারা মনে করছেন, গাজার জনগণকে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ করে রাখলে তারা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নিতে পারবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিকল্পনা কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন হবে এবং এটি জাতিগত নিধনের শামিল হতে পারে।
গাজা দখলে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজাকে পুনর্দখল করতে এবং সেখানে দীর্ঘমেয়াদী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হতে পারে, যা ৪টি সেনা ডিভিশনের সমান। এই সেনাবাহিনী গাজার স্থায়ী শাসন পরিচালনা করবে এবং সেখানে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে।
ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা পুনর্দখলের মাধ্যমে হামাস এবং অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশঙ্কা করছে, এই ধরনের দখলদারিত্ব মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতের জন্ম দিতে পারে এবং গাজার জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে।
গাজার ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
ইসরায়েল নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজার ত্রাণ ব্যবস্থার ওপরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠন গাজার জনগণের জন্য ত্রাণ সরবরাহ করছে। তবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) গাজার ত্রাণ সরবরাহ করবে, যার ফলে ফিলিস্তিনিরা সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং বলেছে, এটি মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ইসরায়েলের কৌশলগত বিষয়াদি সম্পর্কিত মন্ত্রী রন ডেরমার চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। এই সফরের সময় তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গাজা উপত্যকার দখল নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। ইসরায়েলি মন্ত্রীরা চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই পরিকল্পনায় সমর্থন দিক, যাতে গাজায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, গণবাস্তুচ্যুতি বা ব্যাপক স্থানান্তর মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে, গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে। ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন হামলা শুরু করার পর থেকে গাজায় অন্তত ৭৩০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কমপক্ষে ৪০০ জন নারী ও শিশু।
ইসরায়েলের বিমান হামলা, আর্টিলারি শেলিং এবং গুলি চালনার ফলে গাজার বহু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এই সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ বাড়ছে।
ইসরায়েলের এই নতুন পরিকল্পনা গাজার রাজনৈতিক ও মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা দখল করা সহজ হলেও সেখানে দীর্ঘমেয়াদী শাসন কায়েম করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
বিশ্ব সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে ইসরায়েলি সরকার এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে এবং এটি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক চাপ এবং কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই সংকট কতটা সমাধান করা সম্ভব।