Sadrul Law:
দেশে রাজনীতিতে চলছে দল গঠনের প্রতিযোগিতা। নানা নাম আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে আগমন হচ্ছে একের পর এক রাজনৈতিক দলের।
আওয়ামী লীগের পতনের পর গত আট মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে ২৪টি রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে রাজনীতিতে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও প্রতিটি নির্বাচনের আগে এরকম নতুন নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ঘুরেফিরে চেনা কিছু মুখ পুরোনো মঞ্চ ছেড়ে নতুনভাবে সামনে আসেন। এদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন দলের আগমন ইতিবাচক হলেও প্রচলিত ধারায় দলগুলোর বেশির ভাগের টিকে থাকা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলেন, শুধু ইচ্ছা হলো, আর একটা পলিটিক্যাল দল নিয়ে আসলাম, এটা হলে কিন্তু ঘটনা আগের মতোই হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে আবার নিমিষেই ঝরে যাবে।
বিগত কয়েক দশক ধরে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের দৌড় শুরু হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত বিএনএম-এ যোগ দিয়ে নোঙর মার্কা প্রতীকে অংশ নেন ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর।
কিন্তু বিপুল ভোটে পরাজিত শুধু নন তার জামানতও বাজেয়াপ্ত হয় এবং তিনি তৃতীয় স্থান পান। বিএনএমে যোগ দিতে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ ছাড়েন তিনি। সর্বশেষ গত শুক্রবার বিএনএম এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের থেকে পদত্যাগ করে জনতার পার্টি বাংলাদেশে যোগদান করেন তিনি।
তাকে পার্টির উপদেষ্টা পদ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিনি আট বার দল পরিবর্তন করলেন। ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’র মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন শওকত মাহমুদ। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। দলীয় ‘শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে’ লিপ্ত থাকার অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ মার্চ শওকত মাহমুদকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানসহ দলের সব পদ থেকে ‘বহিষ্কার’ করা হয়।
এর কয়েক দিন আগে বনানীতে জাতীয় ইনসাফ কমিটি (ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস) নামের এক সংগঠনের ব্যানারে এক অনুষ্ঠানে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে শওকত মাহমুদ বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য এই নতুন দল গঠন করিনি। ২০২৪ সালের যে নির্বাচনটি হয়েছে, সেখানে অনেকে বাধ্য হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমাকে গোয়েন্দা সংস্থা তুলে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে যে ৭০টি মামলা, সেই মামলার একটির রায় ঘোষণা করা হবে-এটা ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
২০১৮ সালে যারা নির্বাচনে গেছে, ২০২৪ সালে নির্বাচনে যাওয়া আর ’১৮ সালে নির্বাচনে যাওয়ার মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য দেখি না। ’২৪ সালের নির্বাচনে যাওয়ার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করি; কিন্তু একইসঙ্গে যারা ’১৮ সালে নির্বাচনে গেছেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন- তাদেরও তো দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।’
গত ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দলগুলো হলো, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, ‘বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি’, আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি), বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি)। গত আট মাসে গড়ে প্রতি মাসে তিনটা করে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে একমাত্র জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনায়ও আসতে পারেনি।
চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিশাল এক জনসভার মধ্য দিয়ে এ নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়। দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনসিপি বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। সারা দেশে সংগঠনও গুছিয়ে ফেলেছে। জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি এনসিপি আলোচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ।
সর্বশেষ গতকাল ‘বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি’ নামে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দুপুরে রাজধানী ঢাকার তোপখানা সড়কের শিশু কল্যাণ পরিষদ ভবনে এক অনুষ্ঠানে দলটির আত্মপ্রকাশ হয়।
এ সময় নতুন দলের আহ্বায়ক মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সেই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টির পৃষ্ঠপোষক এ টি এম মমতাজুল করিম ৩৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান গতকাল বলেন, সাধারণত দেশে যখন সংকটকালীন সরকার থাকে, তখন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ও সামরিক শাসনামলেও নতুন নতুন দল গঠন হয়ে এসেছে। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা থাকায় চাপের মধ্যে ছিলেন অনেকে। রাজনীতি করার সুযোগটা সীমিত ছিল।
৫ আগস্টের পরে সবার জন্য রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দল গঠন বৃদ্ধির এটাও অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের সংবিধান বা গণতান্ত্রিক যে ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থায় কিন্তু কাউকে রাজনৈতিক দল গঠন করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, অনেক সময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য এই ধরনের ছোট ছোট পার্টি হয়ে থাকে। নির্বাচনে তারা বড় দলগুলোর পক্ষে/বিপক্ষে কাজ করে থাকে। তবে জনগণ নতুন দলগুলোকে কীভাবে নিচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
অতীতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনগণ এই ধরনের ছোট ছোট দলগুলোকে গ্রহণ করেনি। তবে এবার নতুন কোন কোন দল জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পরবর্তী নির্বাচনই এই নতুন দলগুলোর জন্য পরীক্ষাক্ষেত্র।