আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
গত শনিবার ঈদুল আজহার রাতে রাজধানীর গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় সাক্ষাৎ করতে গেলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের খালেদা জিয়া এমন নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদা জিয়াকে ফুলের তোড়া উপহার দেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদের আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সীমা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদের এই নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত জাতীয় নির্বাচনের ওই সময়সীমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর পর ওইদিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এর প্রেক্ষিতে মধ্যরাতেই বিএনপি যে বিবৃতি দেয় তাতে নির্বাচনের প্রাথমিক রোডম্যাপের বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বিবৃতির মধ্যে একপর্যায়ে বলা হয়, ভাষণে ড. ইউনূস শব্দচয়নে রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন কড়া বিবৃতিকে দলটির সিনিয়র নেতারা ভালোভাবে নেননি বলে জানা গেছে। দলের সাধারণ কর্মীরাও একে ভালো চোখে দেখেননি।
বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ড. ইউনূসের সরকারের সঙ্গে বিরোধে না জড়ানোর জন্য স্থায়ী কমিটির নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। তাদেরকে তিনি বলেছেন, দলের ব্যাপারে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা নিয়ে ড. ইউনূস সাহেবের সঙ্গে তারা যেন কথা বলে।
বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক উদ্ধৃত না হয়ে আমার দেশকে জানান, ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের একপর্যায়ে নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপের বিষয়টি উঠে আসে। নতুন রোডম্যাপ অনুযায়ী আবহাওয়ার সংকট, রমজানসহ নানান কারণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের বিরোধে না জড়ানোর নির্দেশ দেন বেগম জিয়া। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতদ্বৈততা থাকলে তা রাস্তায় না এনে ‘প্রাইভেটলি’ সমাধানের কথা বলেন তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের এই নির্দেশনার পর গত সোমবার রাতে আবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, বৈঠকে খালেদা জিয়ার মতামতের ওপর বিশদ আলোচনা করা হয় এবং আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথে এগুনোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে দলটি যে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল, সেখান থেকে কিছুটা নমনীয় অবস্থানে এসেছে। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘সার্বিক বিবেচনায় তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) খুব বেশি দেরি করতে চাইলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে পারত। সেটি হয়তো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হতো।
এছাড়া স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত তারেক রহমানও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার এই বৈঠকের বিষয়ে সম্মতি জানান। ফলে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নীতিনির্ধারক জানান, ড. ইউনূসের সঙ্গে কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সেই দায়িত্ব পুরোপুরি তারেক রহমানের ওপর অর্পণ করা হয়। বৈঠকে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দু-একজন উপদেষ্টাও থাকতে পারেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের কী আলোচনা হতে পারে
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি কী চায় এবং কেন চায়, সেটি লিখিতভাবে তুলে ধরতে পারেন তারেক রহমান। এর মধ্যে তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেতে পারে- নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার। নির্বাচন আরো এগিয়ে আনার জন্য ড. ইউনূসকে অনুরোধ জানাবেন তারেক রহমান। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগে যাতে নির্বাচন করা যায়, সে বিষয়টিতে তারেক রহমান জোর দিতে পারেন বৈঠকে।
জানা গেছে, সংস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, ড. ইউনূসকে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বলবেন তারেক রহমান। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, ঐকমত্য হলেও যেসব সংস্কারে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, সেটা নির্বাচিত সংসদ করবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরিতে উদ্যোগ নিতে সরকারপ্রধানকে আহ্বান জানাবেন তিনি। আর যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো নির্বাচিত পরবর্তী সংসদ করবে। এছাড়া বিএনপি যে জুলাই গণহত্যার বিচার চায় এবং এটি নিয়ে যে তাদের কোনো ধরনের আপস নেই, সেটিও তারেক রহমান স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। তাছাড়া বিচার প্রক্রিয়া যেন দ্রুততম সময়ে দৃশ্যমান হয় এবং সে ব্যাপারে ড. ইউনূস যাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সে বিষয়টিও তুলে ধরবেন।
এছাড়া তারেক রহমান গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিএনপির অবদান বিশেষ করে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী যে হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনের শিকার, সেগুলো তুলে ধরবেন। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি যে নানান ষড়যন্ত্র, সেটিও তুলে ধরার পাশাপাশি বিএনপি যে ড. ইউনূসের অধীনেই নির্বাচন চায় এবং তার হাত ধরেই যে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক- এ বিষয়টিও প্রধান উপদেষ্টাকে বলবেন।
বিএনপির ওই নেতাদের মতে, তারেক রহমান বৈঠকে ড. ইউনূসের কার্যক্রমের প্রশংসার পাশাপাশি ড. ইউনূস যে একটি ক্রিটিক্যাল সময়ে সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটাও তাকে বলবেন।