গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা এবং ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার চাপে জাতীয় পার্টি (জাপা) সপ্তমবারের মতো বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়েছে। দলের বর্তমান ও সাবেক জ্যেষ্ঠ নেতারা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, যা জাপার রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে।
জাপা সূত্রের খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে ভূমিকা পালন করায় দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নেতারা মনে করছেন, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জি এম কাদেরের ভূমিকা দলকে সরকার এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর চাপ থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তাদের দাবি, জি এম কাদের যেভাবে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছেন, তাতে আগামী নির্বাচনে জাপার পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। রাজনীতিতে এবং সরকারের কাছেও জাপার কোনো অবস্থান নেই। তাই জি এম কাদেরকে সরিয়ে নতুন নেতৃত্বের অধীনে বিএনপি-সহ অন্যান্য দলের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জাপা নির্বাচনে টিকে থাকার চেষ্টা করবে।
নেতৃত্ব পরিবর্তনের এই চেষ্টার অংশ হিসেবে, দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। জি এম কাদের সম্মেলন স্থগিত করলেও, তারা আগামী ২৮ জুনই দলের সম্মেলন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চেয়ারম্যান পদে এবং রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। রুহুল আমিন হাওলাদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর চাওয়াতেই তারা প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠরা পাল্টা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচনে’ এমপি হয়ে যদি জি এম কাদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হন, তাহলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং রুহুল আমিন হাওলাদার আরও বড় ‘দোসর’। তাদের দাবি, এরশাদের সিদ্ধান্ত মেনে জি এম কাদের ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সেই নির্বাচনে মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং রুহুল আমিন হাওলাদার সস্ত্রীক এমপি হয়ে সংসদে শেখ হাসিনার স্তুতি করেছিলেন। তাই তারা নেতৃত্বে এলেও জাপা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা থেকে মুক্তি পাবে না।
দলীয় সূত্রগুলো ধারণা করছে, জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে সরকারি সংস্থার ইন্ধন রয়েছে। যারা নেতৃত্বে আসতে চাইছেন, অতীতে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। গত ২০ মে জাপার প্রেসিডিয়াম সভায় ২৮ জুন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হলেও, প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকার অজুহাতে জি এম কাদের সম্মেলন স্থগিত করেন। তবে বিদ্রোহীরা জানিয়েছেন, সম্মেলনের জন্য হল না পাওয়া গেলে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সম্মেলন করার প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমে জাপা সমর্থন দিলেও, আওয়ামী লীগ আমলের ভূমিকার কারণে ছাত্রনেতারা তাদের বৈঠকে ডাকার বিরোধিতা করেন। এরপর জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং জি এম কাদেরের রংপুরের বাসভবনে হামলাও হয়েছে। জি এম কাদের অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরব হয়ে শেখ হাসিনার সমালোচনা করলেও, জুলাইয়ের একাধিক হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান করার বিরুদ্ধে ছিলেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা অংশ নেয় এবং দল থেকে বাদ পড়েন রওশন ও তার অনুসারীরা। পরবর্তীতে রওশনকে চেয়ারম্যান করে একটি পৃথক জাপা দল গঠিত হয়, যেখানে কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার মতো নেতারা যোগ দেন। তারাও এবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের পক্ষে সক্রিয় রয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ছাড়া আর কেউ প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের পক্ষে নেই। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও ‘কোনো দিকেই নেই’ বলে জানিয়েছেন।
১৯৮৬ সালে এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাপা ইতিপূর্বে ছয়বার ভেঙেছে। যদিও ভোটের মাঠ থেকে দলটি দিন দিন হারিয়ে গেছে, তবুও গত তিন সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দলের আসনে ছিল। প্রত্যেকবারই আওয়ামী লীগের আসন ছেড়ে দিয়ে দলটির নেতারা সংসদে গিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার স্তুতি করে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’-এর তকমা পেয়েছেন। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন বলে অনেকেই মনে করছেন। সরকারে থাকা অবস্থায় জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় ছাড়াও ক্ষমতা হারানোর পর দলীয় প্রধানসহ অনেক নেতার দেশত্যাগ দলটিকে বড় সংকটে ফেলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, আওয়ামী লীগ তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কতটা ভুল স্বীকার করে এবং কিভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে, তার ওপরই নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনে দলটি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দলে সুবিধাবাদীদের ভিড় বেড়েছিল। তারা এখন সরে পড়েছেন। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই প্রকটভাবে এসেছে যে, তা দলটির ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছে।’ এই পরিস্থিতি থেকে জাপা কিভাবে বেরিয়ে আসে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।