
ব্রিটেনের রাজকীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উইন্ডসর ক্যাসেলের রাজকীয় এপার্টমেন্টে একটি উন্মুক্ত ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রবিবার (১০ মার্চ), ১,০০০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো, সেন্ট জর্জ হলের রাজকীয় পরিবেশে ৩৫০ জনেরও বেশি মানুষ একত্রিত হয়ে রমজানের উপবাস ভঙ্গ করেন।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি বহু মানুষের কাছে ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। একজন অংশগ্রহণকারী বিবিসিকে বলেন, “এটি এক আশ্চর্যজনক পরিবেশ—বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না!”
ইফতারের রাজকীয় মঞ্চ: ইতিহাস ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মিলন

উইন্ডসর ক্যাসেল ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজকীয় অতিথিদের জন্য ব্যবহৃত হয়। সেখানে প্রথমবারের মতো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ইফতারের আয়োজন নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
রাজা চার্লস III বহু বছর ধরে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে আসছেন। উইন্ডসর ক্যাসেলের পরিদর্শন পরিচালনা বিভাগের পরিচালক সাইমন ম্যাপলস বলেন, “রাজা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সংহতি ও বৈচিত্র্যের পক্ষে কাজ করে আসছেন। এটি তার দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ।”
লন্ডনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা “রমজান টেন্ট প্রজেক্ট” এই ইফতার আয়োজন করে, যা ব্রিটেনজুড়ে খোলা ইফতার অনুষ্ঠান পরিচালনা করে।
ইফতার শুরু: প্রার্থনা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা
সেন্ট জর্জ হলের রাজকীয় সৌন্দর্যের মাঝে রমজানের ইফতার অনুষ্ঠান শুরু হয় আজানের ধ্বনির মধ্য দিয়ে। হাজার বছরের পুরনো এই রাজপ্রাসাদে প্রতিধ্বনিত হয় ইসলামের এই পবিত্র আহ্বান।
এরপর রীতি অনুসারে, অংশগ্রহণকারীরা খেজুর ও পানি দিয়ে রোজা ভাঙেন এবং নামাজ আদায় করেন। পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য এক রাজকীয় ভোজের আয়োজন করা হয়।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, “এটি সত্যিই রাজপরিবারের উদারতার পরিচায়ক। আমরা কখনো ভাবিনি যে, আমরা এখানে বসে ইফতার করব। এটি প্রমাণ করে যে, আমরা একটি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি।”
আরেকজন বলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তাই উইন্ডসর ক্যাসেলে বসে ইফতার করার কথা কখনো ভাবিনি। আমার মুসলিম পরিচয় এবং ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ এখানে একসাথে মিশে গেছে—এটি সত্যিই বিশেষ কিছু।”
একজন উপস্থিত মুসল্লি বলেন, “আমি কখনো উইন্ডসর ক্যাসেলে আসিনি, তাই এটি আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। প্রথমবারের মতো এখানে আসা এবং তা ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত—অবর্ণনীয়!”
রাজাকে ইফতারে আমন্ত্রণ
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে, এক অতিথি রাজাকে ব্যক্তিগতভাবে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে পুরো রমজান মাস আছে, যে কোনো দিন, যে কোনো সময় চলে আসুন!”
ইফতার অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ও রমজান টেন্ট প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ওমর সালহা বলেন, “রাজা ধর্মীয় সংহতির একজন গুরুত্বপূর্ণ দূত। তিনি ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়কে যেভাবে সমর্থন করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”
সবার জন্য উন্মুক্ত ইফতার
ব্রিটেনে ইফতার শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যই নয়, বরং এটি একটি আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠছে। উইন্ডসর ক্যাসেলের এই ঐতিহাসিক ইফতার প্রমাণ করে যে, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ঐতিহ্যের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।
এই ইফতার শুধু একটি খাবারের আয়োজন নয়, বরং এটি ছিল সংহতি, একতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
ব্রিটেনজুড়ে এমন ইফতার অনুষ্ঠান চলছে, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই উদ্যোগ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও একটি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
উইন্ডসর ক্যাসেলে এই ঐতিহাসিক ইফতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটেনের রাজপরিবার যে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, “এটি শুধু খাবার ভাগাভাগি নয়, বরং একসাথে বসে বন্ধন গড়ে তোলার মুহূর্ত।”
এই ইফতার শুধুমাত্র ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা: ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যই আমাদের একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে।