আনোয়ার মুরাদ-ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘাত এক দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল ইস্যু, যা প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা পাচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকে এ যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে গাজার ওপর ব্যাপক সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, যা মানবিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুদ্ধবিরতির ব্যর্থতা এবং ইসরায়েলের নতুন সামরিক অভিযান গাজায় আরও রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা সংঘাতের সাম্প্রতিক আপডেট, মানবিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া, এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব বিশদভাবে আলোচনা করব।
নতুন করে যুদ্ধের সূত্রপাত
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা কমেনি। গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর, ইসরায়েল নতুন করে গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
হামাসের নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত দুই দিনে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৩০ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া, সর্বশেষ রাতভর হামলায় আরও ৮৫ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, এবং ১৩৩ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) জানিয়েছে, তারা হামাসের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং হামাসের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। তবে, অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ এবং বেসামরিক অবকাঠামো বলে জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
ইসরায়েল বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে, তারা গাজার উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে কৌশলগত বিভাজন তৈরির জন্য নেতজারিম করিডোরে স্থল অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েলি সেনারা উত্তর গাজা থেকে উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা হামাসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
IDF-এর মুখপাত্র কর্নেল অভিচাই আদ্রায়ি বলেছেন, “আমরা এই অঞ্চলকে হামাস মুক্ত করতে চাই এবং গাজার উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের সংযোগ সীমিত করতে চাই।”
এই করিডোর তৈরির ফলে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে যাওয়া হাজার হাজার ফিলিস্তিনির জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
হামাসও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, তারা বৃহস্পতিবার তেল আবিব লক্ষ্য করে তিনটি রকেট ছুঁড়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রকেটগুলোর মধ্যে একটিকে প্রতিহত করেছে এবং বাকি দুটি খোলা জায়গায় পড়েছে।
গাজার পরিস্থিতি
গাজায় মানবিক পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং ওষুধের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে ২৫ লাখ গাজার অধিবাসী মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অনেকেই ইতিমধ্যে কয়েকবার আশ্রয় পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা সংকট
গাজার প্রধান হাসপাতাল নাসের হাসপাতালে আহতদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ডাক্তার তানিয়া হাজ হাসান বলেছেন, “গত ২৪ ঘণ্টায় এত বেশি আহত রোগী এসেছে যে আমরা অনেককে চিকিৎসা দিতে পারছি না। অনেকে জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর আগেই মারা যাচ্ছেন।”
ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা থেকে অনেক মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে আহতদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে জাতিসংঘের পাঁচজন কর্মী নিহত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “তারা শিক্ষক, ডাক্তার ও নার্স ছিলেন। এই সহিংসতা অব্যাহত থাকলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছে, হামাসের হুমকি নির্মূল করাই তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে, ওয়াশিংটন গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি রোধের জন্য ইসরায়েলকে আরও মানবিক পদ্ধতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইসরায়েলকে হামাসের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিয়েছে
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা
বর্তমানে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধবিরতির আলোচনা নেই। তবে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লে, উভয় পক্ষ আলোচনায় ফিরে আসতে পারে।
হামাস যদি আরও কয়েকজন জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়, তাহলে ইসরায়েল সামরিক অভিযান কিছুটা কমাতে পারে। তবে, সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি শিগগিরই বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গাজার পুনর্গঠন ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান
এই যুদ্ধের ফলে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। যুদ্ধে হাজার হাজার ভবন, হাসপাতাল, স্কুল ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে গাজার পুনর্গঠন নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
দীর্ঘমেয়াদে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান না হলে এই সংঘাত চলতে থাকবে। শান্তি আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষ যদি সমঝোতায় আসে, তবে এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
ইসরায়েল ও হামাসের সাম্প্রতিক সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। গাজায় মানবিক বিপর্যয় গভীর হয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংঘাতের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভবিষ্যতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেলে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে পারে, তবে তাত্ক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এই প্রতিবেদনে আমরা সাম্প্রতিক পরিস্থিতির একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি। আপনাকে কি আরও নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য লাগবে?