ইউক্রেনে তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধ ইউরোপের জন্য বিপুল আর্থিক ব্যয় বয়ে এনেছে। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে সরাসরি সহায়তা হিসেবে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রায় ১২২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, এর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখনো রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২২৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জমাকৃত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে রাজি হয়নি, যা ২০২২ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসনের পর জব্দ করা হয়েছিল।
রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্তের আহ্বান
গত সপ্তাহে, ফ্রান্সের সংসদ একটি অ-ঐচ্ছিক (non-binding) প্রস্তাব পাস করেছে, যাতে ফরাসি সরকারকে রাশিয়ার স্থগিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা ও পুনর্গঠনে ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষত, সম্পদ থেকে অর্জিত সুদের পরিবর্তে মূলধন অর্থাৎ জমাকৃত সম্পদই ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ইতোমধ্যেই আইন পাশ করেছে, যা তাদের সরকারকে রাশিয়ার জমাকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে। বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন ইউরোপীয় মিত্রদের রাজি করানোরও চেষ্টা করেছিল, যাতে তারা রাশিয়ার স্থগিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়।
ইইউর দ্বিধা ও সাম্প্রতিক পদক্ষেপ
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় সংসদও একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যেখানে রাশিয়ার স্থগিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও পুনর্গঠনে ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে, এখনো সংসদের সদস্যরা এই প্রস্তাবের ওপর আনুষ্ঠানিক ভোট দেয়নি।
বর্তমানে, ইইউ ইতোমধ্যে রাশিয়ার স্থগিত সম্পদ থেকে অর্জিত সুদ ব্যবহার করে ইউক্রেনকে বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু ইউরোপীয় সরকারগুলো এখনো মূলধন বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারে সতর্ক।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ১৫ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেন, এটি একটি “জটিল বিষয়” এবং ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে ইউরোপের আইনগত ও অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইউরোপের সামনে এক বিশাল আর্থিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থগিত থাকা ২২৯ বিলিয়ন ডলারের মূলধন বাজেয়াপ্ত করা এখনো অনিশ্চিত।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি
ফরাসি সরকারের মুখপাত্র সোফি প্রিমাস গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এই রাশিয়ার সম্পদ স্পর্শ করছি না,” কারণ এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, যা ইউরোপে বৈদেশিক বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
একটি বড় উদ্বেগ হল চীন, যা তাইওয়ানে আগ্রাসনের কারণে ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে। ইউরোপ যদি রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, তবে চীন ইউরোপে তার অর্থ রাখার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।
রাশিয়া ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার সরকারি তহবিল সরিয়ে নিচ্ছে, ইউক্রেন ও জর্জিয়ায় আগ্রাসনের কারণে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায়।
অর্থনীতিবিদ ওলেনা হাভ্রিলচিক, যিনি প্যারিসের পন্থেয়ন-সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উল্লেখ করেছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছিল, একইভাবে আফগানিস্তান ও ইরাকের সম্পদও জব্দ করেছিল। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপ এতদিন তেমন শঙ্কিত ছিল না।
আইনি বাধা ও উদ্বেগ
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউরোপ সরাসরি রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ আন্তর্জাতিক আইনে একটি দেশের বিদেশে রাখা সম্পদের “অভেদ্যতা” (State Immunity) স্বীকৃত।
বেলজিয়ামের লোভাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রেডেরিক ডোপ্যাগনে বলেন, “এই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি যুক্তি থাকা জরুরি,” কারণ এটি আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করতে পারে।
ইউক্রেনের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অর্থনীতিবিদ হাভ্রিলচিক মনে করেন, “রাশিয়া কখনোই স্বেচ্ছায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে ক্ষতিপূরণ দেবে না। ফলে ইউক্রেনের একমাত্র সুযোগ হল পশ্চিমা দেশে রাশিয়ার ইতোমধ্যে জব্দকৃত সম্পদ।”
তবে ইউরোপ এখনো এটি বাজেয়াপ্ত না করে শুধুমাত্র এর সুদ ব্যবহার করছে ইউক্রেনকে অর্থায়ন করতে। কিন্তু এই সুদের পরিমাণ যুদ্ধের বিশাল ব্যয় বহন করার জন্য যথেষ্ট নয়।
“বিশ্ব কেবলমাত্র অর্থনীতিবিদদের দ্বারা শাসিত হয় না,” হাভ্রিলচিক বলেন। “আন্তর্জাতিক আইন কেবল সম্পত্তির অধিকারের জন্য নয়, বরং ন্যায়বিচারের জন্যও রয়েছে।”
এই বিতর্ক এখনো চলছে, এবং ইউরোপীয় সরকারগুলোকে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি শুধুমাত্র রাশিয়ার সম্পদের সুদ ব্যবহার করবে, নাকি পুরো মূলধন বাজেয়াপ্ত করবে।