Sadrul Ain:
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত জুলাইয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার যে জায়গায় নাদিমুল হাসান নিহত হন ঠিক তার অল্প কিছু দূরে তারই সঙ্গে আন্দোলন করছিলেন আরেক শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার।
অথচ তারই বাবাকে আসামি করা হয়েছে ঐ হত্যা মামলায়। নাম বাদ দিতে তাদের কাছে টাকা দাবি করা হয়েছে। সুলতানা আক্তার বলেন, যে ছেলেটা আমার সামনে মারা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে, তার মামলায় আমার বাবাকে (আসামি) দিছে। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম এটা কীভাবে সম্ভব? এটা তো সম্ভব হতে পারে না।
ঐদিন ওর থেকে এক হাত দূরে, যদি ঐ গুলিটা ওর গায়ে না লাগত, আমার গায়ে তো লাগতে পারত। অথচ আমার বাবার নাম হত্যা মামলা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে।
শুধু এই ঘটনা নয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে করা মামলাগুলোতে এরই মধ্যে আসামি করে, আসামি করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি, কিংবা মামলা থেকে নাম খারিজ করে দেওয়ার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মামলাবাণিজ্য বন্ধে কঠোর হচ্ছে পুলিশ। কারণ পুলিশের বিরুদ্ধেও এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে এমন অভিযোগে শাহিন পারভেজ নামে এক জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে জুলাই অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত মামলায় আসামি গ্রেফতারের আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, সে বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ হাজির করার কথাও বলেছে পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার এসব নির্দেশনা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছে ডিএমপি। ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ঐ অফিস আদেশে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্তে রুজু করা মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা অধিক।
এসব মামলার এজাহারভুক্ত কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেফতারের জন্য উপযুক্ত প্রমাণসহ (ভিকটিম, বাদী, প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী, ঘটনা সংশ্লিষ্ট ভিডিও, অডিও, স্থির চিত্র ও মোবাইলের কল লিস্ট বা সিডিআর ইত্যাদি) অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গ্রেফতার করতে হবে।
কাওসার হোসেন হূদয়। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় নিজ গ্রামে গরুর খামার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ঢাকায় খুব একটা আসাও হয় না। সর্বশেষ এসেছেন প্রায় চার বছর আগে। কয়েক দিন আগে জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে রাজধানীর মিরপুর থানায়।
এমন ঘটনায় হতবাক তিনি। এরই মধ্যে পরিচিত এক পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন শুধু তিনি নন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত তার দুই ভাইয়ের নামেও মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বড় ভাই নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুটি ও ছোট ভাই ফখরুল ইসলাম শামীমের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে।
অথচ তারাও কেউ মিরপুরের বাসিন্দা নন। একজন নোয়াখালীর বসুরহাটে কর্মরত। আরেক জন রাজধানীর ইমামগঞ্জে। এ ঘটনায় বিধ্বস্ত কাওসারের পরিবার। কী করবেন বুঝছেন না কাওসারের পরিবারের সদস্যরা। এমন অভিযোগ অসংখ্য।
অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা ঢালাও মামলার তদন্ত নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। হত্যা মামলা আদালতে প্রমাণ করার জন্য যেসব তথ্যপ্রমাণ ও আলামত লাগে সেগুলো খুঁজে পেতে পুলিশকে বেগ পেতে হচ্ছে। ঘটনার অনেক পরে মামলা হওয়াতে কোনো আলামতও পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেক নিহতদের ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। হত্যা মামলা প্রমাণ করার জন্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, হত্যার আলামত, যে অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেটি বা গুলি করে হত্যার আলামত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। কীভাবে মামলা প্রমাণ করবে—তা নিয়ে বিপাকে পুলিশ।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করে কয়েক বারই বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ভুয়া মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, গণহত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে খোদ সহকর্মীর কাছ থেকেও ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পদবি বুঝে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকাও ঘুষ দাবির অভিযোগ আছে।
১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রামপুরা থানার এসআই অনুপ বিশ্বাস ইটের আঘাত পেয়ে আহত হন। পরে তিনি কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। পরে তিনি জানতে পারেন ১৯ জুলাই খিলগাঁও এলাকায় বিক্ষোভে এক জন আহত হওয়ার ঘটনায় ১৭ অক্টোবরের এক মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে।
অথচ ঘটনার সময় তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরে ঐ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অনুপের কাছে লাখ টাকা ঘুষ চান তারই এক সহকর্মী। কিন্তু তিনি ঘুষ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তাকে বলা হয় ঘুষ না দিলে একাধিক হত্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হবে।
অনুপকে যে হত্যা চেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে ঐ মামলায় অন্য আসামিদের পাশাপাশি পুলিশের ৩৬ জন সদস্যকে আসামি করা হয়। অন্য আরেকটি মামলায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগে রামপুরা থানার এসআই রাশেদুর রহমানকে আসামি করা হয়।
কিন্তু ঘটনার ১১ দিন আগে ৮ জুলাই তাকে ভাসানটেক থানায় বদলি করা হয়েছিল। তাই তিনি ভাষানটেক থানায় ডিউটি করছিলেন। কিন্তু যে ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে সেটি রামপুরা এলাকার। রাশেদের প্রশ্ন তিনি ভাষানটেক থেকে কীভাবে রামপুরায় গুলি চালালেন। এই মামলায়ও তার কাছে টাকা দাবি করেন এক সহকর্মী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ‘কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানি শিকার না হন এবং প্রকৃত অপরাধীরা যেন ছাড়া না পান—সে ব্যাপারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মামলায় গ্রেফতার ও প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা তদন্তকারী কর্মকর্তার রয়েছে।
তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলাগুলোতে ঢালাও আসামি করায় বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে মামলা হলেই আসামি গ্রেফতার না করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বারবার। এখন লিখিতভাবে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার না করতে গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদরদপ্তর থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রাথমিক তদন্তে কারও বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে তার নাম মামলা থেকে প্রত্যাহার করার কথাও বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী একাধিকবার জানিয়েছেন, মামলা হলেই গ্রেফতার করতে হবে—এই নীতি থেকে পুলিশকে সরে এসে বিচার-বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় সারা দেশে ১ হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯৯টি হত্যা মামলা। প্রত্যেকটি মামলায় বিপুল সংখ্যক মানুষের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত কয়েক হাজার আসামি করা হয়েছে।