বিশেষ প্রতিবেদক
ঢাকা থেকে
রাজধানীর শেখেরটেক এলাকায় নেমে এলো গভীর শোকের ছায়া। বাবাকে হারিয়ে, ধর্ষণের নির্মম আঘাত বয়ে বেড়িয়ে, শেষ পর্যন্ত ১৮ বছরের তরুণীটি জীবন থেকে বিদায় নিলেন।
শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, এটি আত্মহত্যা।
আদাবর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কমল চন্দ্র ধর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন,
“আমরা এখনো তদন্ত চালাচ্ছি, তবে আপাতত এটিকে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করা হচ্ছে।”
সংগ্রামী এক পরিবারের করুণ পরিণতি
মেয়েটির বাবা আদাবর ইউনিট বিএনপির কর্মী ছিলেন। গত বছরের ২৩ জুলাই, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান তিনি। বাবাকে হারিয়ে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার মা এবং ছোট ভাইবোনদের কাঁধে। নানা সংগঠনের সাহায্যে কোনোভাবে চলছিল তাদের জীবন।
মেয়েটি থাকতেন পটুয়াখালীর দুমকিতে, দাদির কাছে। সেখান থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার জন্য। কিন্তু জীবন তার জন্য আরেকটি কঠিন বিপর্যয় বয়ে আনে।
গত ১৮ মার্চ, বাবার কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে তিনি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। পরদিন থানায় মামলা দায়ের হলেও, বিচার এখনো ঝুলে আছে।
বেঁচে থাকার যুদ্ধ, আর শেষ পর্যন্ত হার
ধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই সে হতাশায় ভুগছিল। মানসিক সংকটের পাশাপাশি শুরু হয়েছিল শারীরিক অসুস্থতা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। চিকিৎসার জন্য দুই দিন আগে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। মা ভাড়া বাসায় থাকতেন শেখেরটেকের ৬ নম্বর রোডে, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে।
মেয়েটির মা কান্নাভেজা কণ্ঠে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন,
“ধর্ষণের পর থেকে ওর মনটা ভেঙে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে কথা বলত না, কারো সাথে দেখা করত না। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসা চলছিল। কখনো ভাবিনি ও এমন একটা পথ বেছে নেবে।”
মেয়ের মৃত্যুতে মাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
নেতাদের প্রতিক্রিয়া ও বিচারহীনতার প্রশ্ন
মেয়েটির মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। তিনি বলেন,
“ওর বাবা আমাদের ইউনিটের কর্মী ছিলেন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। তারপরও আমরা সঠিক বিচার পাইনি। আজ সেই পরিবারের আরেক সদস্যকেও হারালাম।”
He also said,
“এত অন্যায়-অবিচার সহ্য করার পরেও যদি রাষ্ট্র ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব?”
পটভূমি: জুলাই অভ্যুত্থান
২০২৩ সালের জুলাই মাসে সারাদেশব্যাপী ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি চরম রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়। তৎকালীন বিরোধী দলের (বিএনপি) আহ্বানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের সময় বহু মানুষ আহত হয়, প্রাণ হারান অন্তত কয়েকজন। নিহত কর্মীদের পরিবার এখনও ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে।
মেয়েটির বাবাও ছিলেন সেই আন্দোলনের এক শহীদ। কিন্তু তার পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের সাড়া ছিলো নিস্তব্ধ।
মানসিক স্বাস্থ্য: যে অবহেলিত যুদ্ধ
এই ঘটনার পেছনে আরও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য.
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীরা শুধুমাত্র আইনি লড়াই নয়, সামাজিক চাপ এবং মানসিক যন্ত্রণার দ্বৈত যুদ্ধে জর্জরিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পায় না যথাযথ কাউন্সেলিং, মনোবিদ সহায়তা বা নিরাপদ আশ্রয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতি পাঁচজনের একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত মনোবিদ ও কাউন্সেলিং সেবা এখনো বড় শহরের বাইরে বিস্তৃত হয়নি। ধর্ষণের শিকারদের জন্য কোনো আলাদা ট্রমা-কেয়ার ইউনিটও কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
এই তরুণীর মৃত্যুর ঘটনাটি আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো—শুধু আইনি বিচার নয়, জরুরি হলো মনের যুদ্ধের জন্যও রাষ্ট্রীয় সহায়তা.
সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া: নীরবতার ভেতরে কান্না
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমেছে ক্ষোভের ঝড়। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—
“শুধু মামলা নিয়ে বসে থাকলেই কি ন্যায়বিচার হয়? ধর্ষণের শিকারদের মানসিক পুনর্বাসনে কোথায় রাষ্ট্রের ভূমিকা?”
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও দ্রুত বিচার দাবি করেছে।
Last words
এই তরুণীর বিদায় কেবল একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য একটি গভীর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
একজন বাবার মৃত্যুতে ন্যায়বিচার না পেয়ে, এক মেয়ের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়ে, আজ তার জীবন প্রদীপও নিভে গেল।
এখন সময়, শুধু প্রতিবাদের নয়, উদ্যোগের। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, এবং ভুক্তভোগীদের জীবন বাঁচাতে প্রকৃত সহানুভূতির কাঠামো গড়ে তোলার।