কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশের কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং এটিকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জিপিএ-নির্ভর ভর্তি পদ্ধতি চালু থাকলেও তা প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর ছিল না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করা এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে একাধিক বৈঠক শেষে সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত সংশ্লিষ্ট সকলেই একমত হয়েছেন যে, কারিগরি শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান জিপিএ-নির্ভর ভর্তি প্রক্রিয়ার কারণে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ, জিপিএ শুধুমাত্র পরীক্ষার নম্বরের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়িত হয়, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান যাচাই করতে যথেষ্ট নয়। এছাড়া, ২০১৬ সালে সরকার কর্তৃক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করার পর বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে মানসম্মত শিক্ষার্থী বাছাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, ধীরে ধীরে কারিগরি শিক্ষার মানের অবনতি ঘটে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ড একটি রেজুলেশন তৈরি করেছে। এই রেজুলেশনের আওতায় কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা, পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা এবং নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করে শিল্প ও প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় সাধন করা।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল কবীর জানান, “২০১৬ সালে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করার পর আমরা লক্ষ্য করেছি যে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করা কঠিন হয়ে গেছে। ফলে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নতুন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কঠোরভাবে শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হয়। বাংলাদেশেও একই রকম একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। নতুন ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার্থীরা শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, বরং বাস্তবজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে।”
কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে বোর্ড ইতোমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, উন্নতমানের ল্যাবরেটরি স্থাপন, শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ ও অ্যাপ্রেন্টিসশিপ প্রোগ্রামের সুযোগ সম্প্রসারণ করা।
নতুন ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অনেকে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, এই উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীদের মান উন্নত হবে এবং তারা শিল্পখাতে আরও দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে শিল্প বিপ্লব ৪.০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগরি কর্মী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই, আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করুক। তাই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু মেধাবীদের বাছাই নয়, তাদের ভবিষ্যতের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও করে দেওয়া হবে।”
এদিকে, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষরা মনে করেন, নতুন ভর্তি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ভিত্তি আরও মজবুত হবে এবং তাদের শিল্পখাতে প্রবেশের সম্ভাবনা বাড়বে। একজন অধ্যক্ষ বলেন, “কারিগরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যদি আমরা মেধাবী ও আগ্রহী শিক্ষার্থী বাছাই করতে পারি, তাহলে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ হবে।”
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে। এখন শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষা। অনুমোদন পাওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষার তারিখ, পদ্ধতি এবং সিলেবাস নিয়ে বিস্তারিত ঘোষণা দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার মান যুগোপযোগী হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া, বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির ক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।