সউদ আব্দুল্লাহ ,কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি:
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় এবার চলতি মৌসুমে আলু চাষে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কঠিন বিপদের মুখে পড়েছেন। বাজারে আলুর দরপতন, উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি এবং হিমাগারে সংরক্ষণ ভাড়ার অযৌক্তিক বৃদ্ধি সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাজারো কৃষক ও আলু ব্যবসায়ী। মৌসুমের শুরুতে ন্যায্য দাম না পেয়ে অনেকে আলু হিমাগারে মজুত করেছিলেন লাভের আশায়। কিন্তু এখন সেই আলু উত্তোলনের সময় এসে হিমাগার মালিকদের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত ভাড়ার মুখে পড়েছেন তাঁরা।টানা এক সপ্তাহ ধরে তারা আন্দোলন, মানববন্ধন,সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও হিমাগার মালিকরা ভাড়া কমাতে নারাজ, ফলে কৃষকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
চলতি মৌসুমে জয়পুরহাট জেলায় ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। অতিরিক্ত উৎপাদন এবং রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে বাজারে আলুর দাম অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কমে গেছে। পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৬৫ কেজি) আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায়, যা গত পাঁচ বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন।
এই পরিস্থিতিতে চাষিরা হিমাগারে আলু রেখে অপেক্ষা করছিলেন বাজার বাড়ার কিন্তু সেখানে আবার নতুন সংকট,হিমাগার ভাড়া। গত বছর যেখানে ৬৫ কেজির বস্তায় ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা, এবার সেটি বেড়ে ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যদিও ভাড়া প্রতি কেজি হিসেবে সামান্য কমিয়ে ৬.৭৫ টাকা করা হয়েছে তবুও প্রতিটি বস্তায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
চাষিদের দাবি, হিমাগার মালিকরা এই ভাড়া নির্ধারণ করেছেন একতরফাভাবে। তারা কৃষকদের আলু দেখিয়ে ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে বেশি সুদে আবার সেই টাকা কৃষকদের দিচ্ছেন যাতে কৃষকরা সহজেই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।
উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৭-১৮ টাকা, হিমাগার ভাড়া ৬.৭৫ টাকা এবং অন্যান্য খরচসহ (বস্তা, সুতলি, লেবার, পরিবহন) প্রতি কেজিতে খরচ দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকারও বেশি। অথচ হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করতে গিয়ে মিলছে কেজিপ্রতি ১১-১২ টাকা। বস্তাপ্রতি গড় লোকসান দাঁড়াচ্ছে সাড়ে ৩০০ টাকার মতো।
হতাশ চাষিরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে তাঁরা মূলধন হারিয়ে পথে বসবেন। আলু ব্যবসায়ী আবুল হোসেন জানান, ঋণ আর সুদের বোঝা নিয়ে আমরা ধুঁকছি। এই বাড়তি ভাড়া আমাদের আরও বিপদে ফেলেছে।
এ অবস্থায় গত ২৯ জুন চাষি-ব্যবসায়ীরা জয়পুরহাট-বগুড়া মহাসড়ক এবং ৩০ জুন মোসলেমগঞ্জ-কিচক আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় প্রতি বস্তার ভাড়া ৩৫০ টাকায় নামিয়ে আনার কিন্তু হিমাগার মালিকরা প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে এখনও ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা আদায় করে চলেছেন।
জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার আলোচনার পরও হিমাগার মালিকরা নিজেদের অবস্থানে অনড়। কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিমা আক্তার জাহান জানান, হিমাগার মালিকদের সাথে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে এবং তাঁরা ভাড়া কমিয়ে ৩৭০ টাকা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে।
আলু রপ্তানিকারক শ্রীলংকার হংফং কোম্পানীর প্রতিনিধি আব্দুল বাসেদ জানান,রপ্তানি খাতেও এবার ধস নেমেছে। গত বছর যেখানে সরকার ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছিল এবার কমে তা হয়েছে ১০ শতাংশ।ফলে রপ্তানিও প্রায় বন্ধের মুখে।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন,‘গত বছর এ সময় ৪৮ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হয়েছে। এবার ১২ টাকা থেকে ১৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে আলুর মূল্য অনেক হ্রাস পেয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভিন বলেন, হিমাগার মালিকরা কেজিপ্রতি এক-দেড় টাকা কমালেই কৃষকরা অনেকটা রেহাই পেতেন। এই লোকসান শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৃষকদের মানসিক ও সামাজিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলছে।
হিমাগার মালিকদের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বৃহত্তর বগুড়া কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও আর.বি স্পেশালাইজ হিমাগারের মালিক প্রদীপ কুমার প্রসাদ দাবি করেন, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
এই সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের প্রফেসর ড. এম আসাদুজ্জামান সরকার মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার অভাব ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কৃষকদের বারবার এই ধরনের সংকটে ফেলছে। তাঁর মতে, কোন এলাকায় কত জমিতে আলু চাষ হবে? সেই অনুযায়ী চাহিদা ও সরবরাহ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তা না হলে, বছর বছর কৃষকরা ক্ষতির দোলাচলে পড়ে আলু চাষকে অলাভজনক মনে করে বিমুখ হয়ে পড়বেন।