Satyajit Das (Moulvibazar Correspondent):
চা মৌসুম শুরুর আগেই মৌলভীবাজারের চা-বাগানগুলো পড়েছে ভয়াবহ খরার কবলে। অনাবৃষ্টি আর প্রখর তাপদাহে পুড়ে যাচ্ছে কুঁড়িপাতা। নতুন চা-কুঁড়ি আসছে না,শুকিয়ে যাচ্ছে গাছের ডালপালা। ফলে বড় ধরনের উৎপাদন সংকটের আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চা-চাষিরা ও বাগান কর্তৃপক্ষ।
চাষিদের ভাষ্য,’টানা কয়েক মাস বৃষ্টি না থাকায় বাগানে নিয়মিত সেচ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। অনেক নদী, ছড়া, জলাশয় ও লেক শুকিয়ে গেছে। যেসব বাগানে সেচ ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে মাটি ফেটে যাচ্ছে,গাছ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে,পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে’।
সোমবার (০৭ এপ্রিল) সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ‘বেশিরভাগ বাগানে নতুন চা-কুঁড়ি দেখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু জায়গায় চারাগাছ পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। পুরনো গাছেরও পাতা ঝরে গেছে। বাগান শ্রমিকরা জানাচ্ছেন,দিনরাত পানি ছিটিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বরং পোকামাকড় ও লাল মাকড়ের আক্রমণ বেড়েছে,যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে’।
চা-বিশেষজ্ঞরা বলছেন,চা-উৎপাদনের স্বাভাবিক গতি ফেরাতে হলে বৃষ্টির পাশাপাশি মাটিতে পচা গোবর ও কিছু পরিমাণ টিএসপি মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রাকৃতিক সহায়তা না পেলে এসব উদ্যোগ খুব বেশি কাজে আসবে না।
জেলা কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়,মৌলভীবাজার জেলায় বর্তমানে ৯৩টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ নতুন চারা ও ১০ শতাংশ পুরনো গাছ খরায় পুড়ে গেছে। বড় বাগানগুলোতে সেচের ব্যবস্থা থাকলেও ছোট ও মাঝারি বাগানগুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
চা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ২২০ টাকা, অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১৮০ টাকায়। ফলে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই অবস্থায় খরার কারণে উৎপাদন কমে গেলে চা-শিল্প টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন,“চা-উৎপাদনের জন্য ২০–২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা উপযুক্ত হলেও বর্তমানে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। এমন অবস্থায় গাছ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারছে না।”
ন্যাশনাল টি কোম্পানির পাত্রখোলা চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আকতার হোসেন বলেন,“বৃষ্টি না হলে এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। কৃত্রিম সেচ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।”
চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব এক ভয়াবহ বাস্তবতা হয়ে উঠেছে এখন। শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়,চলতি বছর মার্চ মাসে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, যেখানে গত বছর এই সময় ছিল ৪৮ মিলিমিটার। গত পাঁচ মাসে উল্লেখযোগ্য কোনও বৃষ্টিপাত হয়নি।
চা-বাগান মালিক,শ্রমিক,বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ এবং প্রাকৃতিক অনুকূলতা ছাড়া এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ অসম্ভব বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন একটাই প্রত্যাশা—দ্রুত বৃষ্টি নামুক, ফিরে আসুক সবুজের স্বাভাবিক ছোঁয়া।