লায়ন উজ্জল কান্তি বড়ুয়া :
মানবতা, সাম্য, বিদ্রোহ ও অসাম্প্রদায়িকতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ ও বিপ্লবী চেতনার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর সাহিত্য ও সংগীতে ফুটে উঠেছে শোষণবিরোধী, স্বাধীনতাকামী এবং মুক্তচেতা একটি সমাজের স্বপ্ন। আজকের বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় বিভাজন, নারীর অবমূল্যায়ন ও সুশাসনের ঘাটতির মতো সমস্যাগুলোর সমাধানে নজরুল চেতনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ নজরুলের আদর্শগুলোই একটি ন্যায়ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গঠনের দিশা দেখায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণ বলেছিলেন- “আমি চিরদাসের চিরবিদ্রোহী দাসানুদাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।” তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশে আজো সামাজিক বৈষম্য, দরিদ্রতা ও বর্ণবিদ্বেষ বিদ্যমান। নজরুল চেতনা আমাদের শেখায়- সত্যিকার প্রগতি তখনই সম্ভব, যখন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সমান সুযোগ ও সম্মান পাবে।
নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার ভিত্তিতে ধর্মের মূল উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি কোরআন, গীতা, বেদ, বাইবেল- সব ধর্মগ্রন্থকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করেছেন। তাঁর লেখা- “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান”, এই চেতনাই আজকের বাংলাদেশে জরুরি। ধর্মের নামে হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে একটি উদার ও সহনশীল সমাজ গঠনে নজরুলের আদর্শ অনুসরণীয়।
নজরুল নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখতে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন – “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” আজকের বাংলাদেশের পুনর্গঠনে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষায় অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নজরুলের এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা কেবল সাহিত্য নয়, এটি শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনার প্রতীক। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, নিপীড়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে স্পর্ধা তিনি দেখিয়েছেন, তা বর্তমান বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দারুণ অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয় ঐক্য, মুক্তির সংগ্রাম ও বাংলাদেশ গঠনের প্রেরণায় নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তাঁর গান, কবিতা ও প্রবন্ধে দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্যের আহ্বান ছিল সুস্পষ্ট। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে কবিতায়, যেমন বিদ্রোহী কবিতায় তিনি ঘোষণা দেন- “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন।” এই দুঃসাহসিক উচ্চারণ উপমহাদেশে জাতীয় চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধকে উজ্জীবিত করেছিল। নজরুল সব সময় জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। তিনি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে একত্রিত করতে চেয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- “জাতি নয়, মানুষ বড়।” এই চেতনা আজকের বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত জরুরি, যেখানে বিভাজনের রাজনীতিকে পেছনে ফেলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। মুক্তির সংগ্রামে নজরুলের গান ছিল জাগরণের বার্তা। তাঁর ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আজও বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর সাহসী লেখনী ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়লেও তিনি দমে যাননি—সেই মনোভাব জাতিকে শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।
Conclusion:
বাংলাদেশের পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় নজরুল চেতনা হতে পারে আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। নজরুল চেতনা কেবল সাহিত্যিক ঐতিহ্য নয়, এটি একটি পথনির্দেশ। মানবতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, অসাম্প্রদায়িকতা ও বিদ্রোহের চেতনায় বলীয়ান হয়ে আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ।
লেখক পরিচিতি : সংগঠক ও কলাম লেখক।