Syed Amiruzzaman
আমাদের পাহাড়গুলি চিরকাল থাকবে
আমাদের নদীগুলি চিরকাল থাকবে
আমাদের জনগণ চিরকাল থাকবে
মার্কিন হানাদার পরাজিত হবে
আবার আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তুলবো
দশগুণ সুন্দর করে
-(হো চি মিনের শেষ ইচ্ছাপত্র, ১৯৬৯)
সারাবিশ্বের মেহনতি মানুষ এবং নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ধ্রুব নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল ভিয়েতনাম বিপ্লবের অবিসংবাদিত কিংবদন্তি বিপ্লবী মহানায়ক কমরেড হো চি মিনের ১৩৫তম জন্মবার্ষিকী আজ।
কমিউনিস্ট বিপ্লবী এই নেতা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার পেছনেও কমরেড হো-র উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। আজ তাঁর ১৩৪তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিগত শতাব্দীর বা বর্তমান সময় পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম আন্তর্জাতিক মহান কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে বিপ্লবী হো চি মিন ছিলেন অন্যতম। যার জীবনে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ ছিল না, অনায়াসে বলতে পারতেন দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে একজন কমিউনিস্ট পাহাড় ভেঙ্গে ফেলতে পারে।
মহান সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড ভ ই লেনিনের লিখিত ‘COLONIAL THESIS’ প্রকাশিত হয়েছিল ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘Lumani’তে। এই থিসিসে অনেক রাজনৈতিক বাক্য ছিল যা হো চি মিন প্রাথমিক পর্যায়ে উপলব্ধি করতে পারেন নি। বারবার পড়ার পর এই থিসিস্ তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। বুঝতে পারেন ভিয়েতনামের মুক্তি আন্দোলনের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ। তিনি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন লাইব্রেরীর কক্ষে বসে Colonial Thesis পড়তে পড়তে আনন্দাশ্রুতে ভিজিয়ে ফেলতেন সেই বইকে। ১৯২৪ সালের ২১শে জানুয়ারী মহামতি লেনিনের মৃত্যুর খবর হো চি মিনের কাছে যখন পৌঁছায় প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন। বিশ্বাস করতে পারেন নি এমন একটি কঠিন সংবাদ। কিন্তু সমগ্ৰ সোভিয়েত ইউনিয়নে অর্ধনমিত লাল পতাকা যেন সোচ্চারে আঘাত করে হো চি মিনের হৃদয়কে। হো চি মিন নিজের মুখেই বলেছিলেন, “লেনিন যখন জীবিত ছিলেন তখন তার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি। সেটা আমাকে সারাজীবন দু:খ দেবে”।
কমরেড হো চি মিন ছিলেন ব্যতিক্রমী কমিউনিস্ট। তত্ত্বকে সহজেই জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারতেন, ভাষা বুঝতেন জনগণের। কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে জনগণের ভালোবাসা পেতে গেলে তুমি বয়স্কদের শ্রদ্ধা করবে, মহিলাদের সম্মান দেখাবে এবং শিশুদের সঙ্গে পিতার মতো ব্যবহার করবে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি বলতেন স্থানীয় রীতিনীতিকে তোমাকে সবসময় সম্মান জানাতে হবে, সেই রীতিনীতি যতই অদ্ভুত ঠেকুক না কেন!
কর্মীদের তিনি তিনভাগে ভাগ করেছিলেন:
১) একদল যে কোনো সংগ্ৰামে বিশ্বস্ত থাকে।
২) আর একদল ঝাঁপায় কিন্তু পুলিশ দেখলেই শামুকের খোলে গুটিয়ে যায়।
৩) আর একদল স্বেচ্ছা বিপ্লবী শেষপর্যন্ত সবাইকে রক্ষা করতে পারে না।
আসল কথা যত বেশী সম্ভব মানুষকে বোঝাতে হবে বিপ্লব অনিবার্য।
হো চি মিন বলতেন,
১) কঠিন শব্দ পরিহার করো
২) জনগণের ভাষায় কথা বলতে শেখ
৩) গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন বোঝানোর আগে তাদের পরিবার সম্পর্কে সচেতন থাকো, তাহলেই দেখবে তোমাদের কথা তারা মন দিয়ে শুনছে।
তিনি মনে করতেন যতই মেধাসম্পন্ন তুমি হও না কেন, এই গুণ রপ্ত করা ব্যতিরেকে একজন কর্মী হয়ে উঠতে পারবে না।
হো চি মিন বিশ্বাস করতেন, “আটাত্তর বছর আর কি এমন বয়স, সে তো শক্ত হাতে দেশের দায়িত্ব নিতে পারে”।
হো চি মিনের লেখা কবিতা আশাবাদের কবিতা।
জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য গান বা কবিতা লিখতে হলেও বুকে কিছু দম লাগে।
তাই তিনি লিখেছিলেন,
“গম পিষছে এক পাড়াগেঁয়ে মেয়ে
সামনে তার জ্বলছে
গনগনে এক উনুন
মানুষের মন পরাজয় জানে না”।
ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা নেতৃত্ব কমরেড হো চি মিন। বিশ্ব ইতিহাসে যে কয়জন নেতৃত্ব সামগ্রিক মুক্তির জন্য সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে স্বাধীনতার দূত হয়ে উঠেছিলেন কমরেড হো চি মিন তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে অসাধারণ ও একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন তারই বড় প্রমাণ হো চি মিন। এই আধুনিক বিশ্বেও তার কীর্তি পরিবর্তন অভিমুখী মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় ও অনুপ্রেরণীয়।
কমরেড হো চি মিন ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠাতা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমৃত্যু ভিয়েত কং-এর নেতৃত্ব করেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছেন নতুন ভিয়েতনামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের। স্বপ্ন দেখেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করেছেন ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা সাধারণ জনগণের জন্য। পড়াশোনা শেষ করেই জড়িয়ে পড়েন ফরাসি বিপ্লবে। তার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তার বাবা নগুয়েন সাক। পরিণতি হিসেবে শাসকগোষ্ঠী অন্যান্য আন্দোলনকারীর সঙ্গে তাকেও গ্রেফতার করে। পরে ফরাসি শাসকগোষ্ঠী সিন সাককে আটকে রাখে পৌলো বন্দর কারাদ্ব্বীপে। বাবা গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল হো চি মিনের ছাত্রজীবন এবং শুরু হলো প্রত্যক্ষ সংগ্রামী জীবন। এ সময় তিনি হুয়েং শহর ত্যাগ করে ফ্যান থিয়েট শহরে চলে যান। সেখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সময়টা ছিল ১৯০৭ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত। ইতিহাসবিদরা এটি তার আন্দোলনের পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এদিকে হো চি মিনের বাবাকে পৌলো বন্দর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। এ সময় বাবার সঙ্গে পুত্রের দেখা হয়। হো চি মিনের বাবা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন তার এ তরুণ সন্তানের মনে ব্যাপক ক্ষোভ আর যন্ত্রণা। তিনি অন্তরদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করলেন এ সন্তান তার একার নয়। এ সন্তান এখন সারা ভিয়েতনামের সংগ্রামী মানুষের। তিনি হো চি মিনকে প্যারিস পাঠানোর চিন্তা করলেন। কিন্তু এ জন্য কারিগরি বিদ্যালয়ে পড়তে হবে তিন বছর। হো চি মিন তিন বছর সময় নষ্ট না করে একটি চাকরি জোগাড় করে ফেললেন। সায়গান আর ফ্রান্সের ভার্সাই বন্দরের মধ্যে যাতায়াতকারী এস এস লা তুচে ত্রিভেলি নামের এক জাহাজে চাকরি হলো তার। তিনি যাত্রা শুরু করলেন প্যারিসের পথে।
ভার্সাই সম্মেলন এবং আট দফা দাবি
প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেমে গেছে। কিন্তু সারা দুনিয়ার ভাগ-বাটোয়ারা শেষ হয়নি। শেষ হয়নি বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর এ স্থানেই ১৯১৯ সালে জার্মানি ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত, নটরডেম প্যারিসে অবস্থিত। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা সেই কাজ শেষ করার জন্য ১৯১৯ সালের বসন্তকালে সম্মিলিত হন ভার্সাইতে। উন্নত বিশ্বের নেতাদের যখন নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বোমা ফাটান বিপ্লবী এই নেতা। বজ্রকণ্ঠে উত্থাপন করলেন আট দফা দাবি। ভিয়েতনামি জনগণের পক্ষ থেকে ‘জাতিসমূহের অধিকার’ শিরোনামে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কে এই প্রস্তাব উত্থাপনকারী যুবক? নগুয়েন ভ্যান কুং অর্থাৎ দেশপ্রেমিক নগুয়েন। শুরু হলো ছদ্মনাম গ্রহণের পালা। নাম হলো হো চি মিন, এর অর্থ আলোর দিশারী। ভার্সাইতে তার উপস্থাপিত মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, ফরাসি ও ভিয়েতনামিদের মধ্যে সমান অধিকার, জবরদস্তিমূলক শ্রম বিলোপ, লবণ কর রহিত এবং জবরদস্তিমূলক মদ্যপান ব্যবস্থার বাতিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রস্তাবই হলো সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের বিরুদ্ধে তার প্রথম আঘাত। ভিয়েতনামের ওপর কর্তৃত্বকারী ফ্রান্সের বুকে বসে ফরাসি উপনিবেশবাদবিরোধী তার পিতৃ-মাতৃভূমির মুক্তির সনদ দাখিল করলেন হো চি মিন। অবাক বিস্ময়ে দেখল বিশ্ব!
দেশে দেশে বিপ্লবী ভাষণ
বিপ্লবী মহান এই নেতা ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাষ্ট্র এবং দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন আন্দোলন করে গেছেন। ১৯২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় দিনের প্যারিস সফরে যান। সেখানে ফরাসি সোশ্যালিস্ট পার্টির ১৮৩তম অধিবেশনে যোগ দেন ভিয়েতনামের প্রতিনিধি হিসেবে। বিশ্ব প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন ভিয়েতনামের ওপর ফরাসিদের নিপীড়নের কথা। দেশের মানুষের ঐক্য আর সংগঠনের মাধ্যমে বিপ্লব গড়ে তুলতে গঠন করেন ভিয়েতনামি বিপ্লবী তরুণ সংঘ। অনেক সংগ্রামের পর ভিয়েতনামে শেষ হয় ফরাসি শাসন। ভিয়েতনামের আলোর দিশারি হো চি মিন তার ভাষণে বলেন, ‘প্রিয় বন্ধুগণ, বিপ্লবের জন্য আপনাদের সাহায্য করার প্রয়োজনে আজ এখানে আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে স্বীকার করছি যে, আমার জন্মভূমিতে যে ঘৃণ্য ও অবিচার সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্য নিয়েই কমিউনিস্ট হিসেবে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা অবগত আছেন, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় হতে চলল ফরাসি পুঁজিবাদী শোষকগোষ্ঠী ইন্দোচীনে তার হিংস্র রূপ নিয়ে এ অঞ্চলে উপস্থিত রয়েছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে বেয়নেটের শক্তিতে তারা আমাদের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেছে। শুরু থেকে আজ অবধি আমাদের ওপর শুধু যে নির্যাতন ও শোষণ চলছে তাই নয়, চলছে অবাধ হত্যাকাণ্ড ও বিষ প্রয়োগও। পুঁজিবাদী লুটেরারা ইন্দোচীনের ওপর কী পরিমাণ কুৎসিত নিপীড়ন চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে তার বিশদ বর্ণনা সামান্য কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনাদের সামনে উপস্থিত করা সম্ভব নয়।’ এ ছাড়া ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হো চি মিন কমিন্টার্নের নির্দেশে চীনের ক্যান্টনে বলেন, ‘একজন মানুষ যা চাইবে ইন্দোচীনে তার সবই আছে। যেমন বন্দর, খনি, বিস্তীর্ণ শস্যখেত, বিরাট বনভূমি এবং যোগ্য ও কঠোর পরিশ্রমী শ্রেণি। কিন্তু আমাদের সংগঠন ও সংগঠকের বড্ড অভাব। সে কারণেই আমাদের শিল্প আর ব্যবসা বাণিজ্যের কোনো মূল্য নেই। যদি তোমার যুবসমাজ জীবনের মধ্যে ফিরে না আসে, তবে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।’
না ফেরার দেশে
মহান এই বিপ্লবী নেতা ১৯৬৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। হো চি মিন হয়তো তার জীবনকালে নিজ দেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। এখন নিশ্চয়ই মৃত্যুর ওপারে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল সেই মহান নেতা যখন দেখেন তার দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে তখন তিনি নিশ্চয়ই আনন্দিত হন। কমরেড হো চি মিন আজও দুনিয়ার শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কাছে অসামান্য প্রেরণা।
শৈশব থেকেই সংগ্রামী
নগুয়েন ভ্যান কুং, নগুয়েন তাত থান, ভুয়ং সন নিহি, লিনভ এবং হো চি মিন প্রতিটি নাম একজন মানুষেরই। প্রথম দুটি ছদ্ম নাম হলেও শেষের নামটিতে তাকে সবাই চেনেন। ছেলেবেলায় আদর করে ‘আঙ্কেল হো’ বলে ডাকা হতো। ১৮৯০ সালের ১৯ মে তার জন্ম। ফরাসি আশ্রিত রাজ্য আন্নামের নগেয়ান প্রদেশের হোয়াংট্রু গ্রামটি তার জন্মস্থান হলেও শৈশব কাটে কিম লিয়েন গ্রামে। বাবার নাম নগুয়েন হুই ওরফে নগুয়েন সিন সাক ছিলেন ক্ষেতমজুর পরিবারের সন্তান। দাসত্বের এ জীবন সিন সাকের ভালো লাগত না। তাই মুক্তির উপায় হিসেবে শিক্ষাকে বেছে নেন। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পড়াশোনা করে হয়ে ওঠেন শিক্ষক। প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে পণ্ডিত আন তার বড় মেয়ে হোয়াং আই লোয়ানের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। হো চি মিনের মা হোয়াং আই লোয়ানও পরিশ্রমী নারী ছিলেন। বাবা-মায়ের মতো হো চি মিনের জীবন সংগ্রামও শুরু হয় শৈশব থেকেই। তার বাবার আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেন। তার যখন বয়স ১০ তখন তারা গ্রাম ছেড়ে বাবার শিক্ষকতা পেশা শুরু করার জন্য হুয়েং শহরে চলে আসেন। সংসারে তিন ভাই-বোনের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো হো চি মিনের বাবার। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হতো হো চি মিনের মায়ের। এভাবে মা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে মারা যান হো চি মিনের মা। মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন তিনি। তার বাবাও হতাশায় পড়েন। ঠিক করা হলো হো চি মিনকে আবারও গ্রামে পাঠিয়ে দেবেন। হুয়েং শহর ছেড়ে হো চি মিন আবারও চলে আসেন তার প্রিয় সবুজ ঘেরা গ্রামে।
পাড়ি জমালেন হুয়েং শহরে
১৯০৪ সালে তরুণ হো চি মিন দ্বিতীয়বারের মতো পাড়ি জমালেন হুয়েং শহরে। গ্রামে থাকার সময় তিনি উপলব্ধি করেন তাকে আরও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তাই পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি তিনি নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষ এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে যান। তার একটাই উপলব্ধি ছিল, ‘শিখতে হবে মানুষের কাছ থেকে, জানতে হবে পৃথিবীকে।’ ১৯০৭ সালে হো চি মিন বিদ্যালয়ের পড়াশোনা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই শেষ করেন। তার পড়াশোনা শেষ হতেই ভিয়েতনামজুড়ে চলতে থাকে খণ্ড খণ্ড ফরাসিবিরোধী বিক্ষোভ। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মাটি থেকে বিদেশিদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা। শহরে এসেই বুঝতে পারলেন নিজেদের মাতৃভূমিতে তাদের কোনো অধিকার নেই। তাদের দেশ শাসন করছে ফরাসিরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফরাসি নাগরিক। অন্য শিক্ষকরা ভিয়েতনামি হলেও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার সাহস ছিল না। স্কুলেই এমন পরাধীনতা তাকে আরও বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত করে। সে সময় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন হলেও সুসংগঠিত কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ঠিক এ সময়ে হুয়েং শহরে গড়ে ওঠে এক গোপন বিপ্লবী সংগঠন। হো চি মিন এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে প্রচারপত্র বিলি করতেন এবং বোঝাতেন, অত্যাচারী ফরাসিদের দেশ থেকে বিতাড়িত না করলে দেশে শান্তি আসবে না। বিদেশি শাসন-শোষণ আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ মানুষ এ আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন, ঠিক তখনই তিনি ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শে। কীভাবে তিনি লেনিনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তা নিজেই লিখেছেন- ‘গোড়ার দিকে, সাম্রাজ্যবাদ নয়, দেশপ্রেমই আমাকে লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগ্রামে, মার্কসবাদ, লেনিনবাদ অধ্যয়ন আর তার পাশাপাশি বাস্তব কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি যে, কেবল সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদই সমস্ত বিশ্বের নিপীড়িত জাতি এবং শ্রমজীবী জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে।’
বিশ্ব ভ্রমণে
কমরেড হো চি মিন সুদীর্ঘকাল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ আর আমেরিকার দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন জাহাজের রসুইখানায় বাবুর্চির সহকারী হিসেবে। প্যারিসে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তা হলো নগরকেন্দ্রিক জীবনের পঙ্কিলতা। শিক্ষা সভ্যতার ছদ্মাবরণে বীভৎস ক্রিয়াকাণ্ডের ঘটনা দ্রুত তার কাছে স্পষ্ট হয়। তার মনে হয় নগরীর ভদ্রজনেরা জরাগ্রস্ত পঙ্গু। সবাই মানসিক ব্যাধির ভুগন্ত রোগী। হো চি মিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে জাহাজের সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে মিশতেন। আর নতুন করে পরিচিত হতেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে।
পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই মহান এই নেতার জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।
ভিয়েতনাম মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা কমরেড হো চি মিন লাল সালাম ও বিপ্লবী অভিবাদন।
#

Syed Amiruzzaman
Liberation War researcher, journalist and columnist;
Special Correspondent, Weekly News;
Editor, RP News;
Member of the Central Committee, National Farmers' Association;
Member of the Editorial Board, Workers' Party of Bangladesh, Moulvibazar District;
Organizer of the great mass uprising of '90 and former central committee member, Bangladesh Chhatra Maitri.
Former Central Committee Member, Bangladesh Agricultural Workers Union.
General Secretary, National Committee for Compensation for Magurchara Gas Resources and Environmental Destruction.
Former President, Bangladesh Law Students Federation.