লায়ন উজ্জল কান্তি বড়ুয়া
আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই পূর্ণিমা তিথিতে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ (মহাভিনিষ্ক্রমণ), ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্বলাভের পর সারনাথে প্রথম ধর্মদেশনা (ধর্মচক্র প্রবর্তন), ৭ম বর্ষাবাসে যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন ও তাবতিংশ স্বর্গে অভিধর্ম দেশনা প্রদান এই পঞ্চ-স্মৃতি বিজড়িত শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য একটি স্মরণীয় ও পবিত্র দিন।
আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য:
বুদ্ধের জন্ম ও জীবনের সূচনা: আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে, তথাগত গৌতম বুদ্ধের মাতা রাণী মহামায়া স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, শুভক্ষণে তার গর্ভে এক পুত্রসন্তান আসবে। এই স্বপ্নটি ছিল শুভ এবং ইঙ্গিতবাহী যে, এই সন্তান হয় রাজচক্রবর্তী রাজা হবে অথবা সংসার ত্যাগ করে জগৎ আলোকিত করবেন।
গৃহত্যাগ: রাজকুমার সিদ্ধার্থের জীবনে এই দিনে এক বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সংসার জীবনের মায়া ত্যাগ করে, স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা, রাজকীয় ভোগবিলাস ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে গৃহত্যাগ করেন, যা “মহাভিনিষ্কমণ” নামে পরিচিত।
প্রথম ধর্মোপদেশ: বুদ্ধত্ব লাভের পর আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনেই তিনি সারনাথের ঋষি পতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় শিষ্য- কৌণ্ডণ্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিত’কে প্রথম ধর্মোপদেশ দেন, যা “ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র” নামে খ্যাত। এখানেই সংঘের উৎপত্তি হয়। সেদিন তার প্রচারিত ধর্মের মূল আবেদন ছিল-জগৎ দুঃখময়, জীবন অনিত্য, জগতের সব সংস্কার অনিত্য। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যুই শাশ্বত। এই দুঃখময় সংসার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বা উপায় তৃষ্ণাক্ষয়, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার সাধনা এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ তথা আটটি বিশুদ্ধ পথে চলা।
যমক ঋদ্দি প্রদর্শন ও অভিধর্ম দেশনা : বুদ্ধের সময়ে ৬ জন তীর্থিক (অন্য ধর্মপন্থী গুরু) দাবি করছিলেন, যে তারা অলৌকিক শক্তির অধিকারী, এবং বুদ্ধ অলৌকিকতা প্রদর্শনে অক্ষম। সেই প্রেক্ষাপটে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মানুষকে সঠিক ধর্মপথে আনতে তিনি শ্রাবস্তীর গণ্ডম্ব বৃক্ষমূলে যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। মাতৃদেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ঋদ্ধিবলে মাতৃদেবীর অবস্থান নির্ণয় করে মাতৃদেবীসহ স্বর্গলোকে অবস্থানকারী স্বত্বগণের সদ্গতি লাভের জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতেই অলৌকিক উপায়ে তাবতিংস স্বর্গে গিয়ে অভিধর্ম দেশনা করেন।
বর্ষাব্রত পালন:
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রত পালনের সূচনাও এই আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে হয়েছিল। ভিক্ষুদের অন্যতম বাৎসরিক আচার বর্ষাব্রত শুরু হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে, শেষ হয় আশ্বিনী পূর্ণিমাতে। বর্ষাকালে সিক্ত বসনে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করা, বস্ত্র তুলে চলাফেরা করা মানায় না বিধায় যেখানে-সেখানে ভিক্ষুদের বাস না করে গৌতম বুদ্ধ বর্ষাবাস গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বৌদ্ধ বিনয় মতে যে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করেন তিনিই কঠিন চীবর লাভের যোগ্য হন। বর্ষাবাস যাপন ব্যতিকে চীবর লাভ করা যায় না। যে বিহারের ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করবে না, সেই বিহারে কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানও করা যাবে না।
আজ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা — বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। আসুন, আমরা সকলে এই পূর্ণিমার পবিত্র আলোয় নিজেদের জীবনে সত্য, শান্তি ও মৈত্রীর আলো জ্বালাই। সকলে চিন্তায়, চেতনায় আত্মজাগরণের উপলব্ধি হোক। ‘সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তু’-জগতের সব জীব সুখী হোক।

লেখক পরিচিতি : সংগঠন ও কলাম লেখক।