লায়ন মো. গনি মিয়া বাবুল
(শিক্ষক, কবি, কলাম লেখক, সমাজসেবক ও সংগঠক)
আমার বাবা মো. ইসমাইল হোসেন—শুধু আমার জন্মদাতা নন, তিনি আমার জীবনের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট, তিনি না-ফেরার দেশে চলে যান। সেদিন বিকেলে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে আমার দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত “কাছম আলী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল” মাঠে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় সাত হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন। জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে শায়িত করা হয়। সেদিন আকাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল—মনে হয়েছিল, আকাশও যেন বাবার শোকে কাঁদছিল।
আমার বাবা ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ, নিরহঙ্কার ও অতুলনীয় পরোপকারী। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি নিঃস্বার্থভাবে দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি। তাঁর হৃদয় ছিল উদার—প্রেমে, শ্রদ্ধায় ও সহমর্মিতায় ভরা। রাগ, ক্ষোভ, জেদ, অহংকার—এগুলো তাঁর চরিত্রে ছিলই না। কাউকে আঘাত করেননি, কাউকে ফিরিয়ে দেননি।
বাবা ছিলেন একজন দায়িত্ববান অভিভাবক, আদর্শবান সমাজসেবক ও কর্মঠ কৃষক। মেট্রিক পাশ করে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে সফলতার সঙ্গে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং জীবনের শেষ দিকে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমাদের জমিতে যারা কাজ করতেন, তাদের সাথেও ছিল তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বাবার নেতৃত্বে আমাদের গ্রামে গড়ে উঠেছিল “টেপিরবাড়ি কৃষক সমবায় সমিতি”, যা দরিদ্র কৃষকদের আর্থিক সহায়তা ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে স্বাবলম্বী করে তোলে।
তিনি সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন। মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, স্কুল—এসব প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। তিনি নিজের জমি দান করেছেন এসব জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য। ১৯৮০ সালে নিজ খরচে আমাদের এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচের ব্যবস্থা করেন, যা ছিল তৎকালীন সময়ে বিরল দৃষ্টান্ত।
স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। বিশুদ্ধ পানির জন্য ১৯৭৮ সালেই বসান টিউবওয়েল। প্রতিনিয়ত গাছ লাগাতেন, পরিবেশ-প্রেমী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রতিবছর বর্ষায় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করতেন এবং নিজের হাতে পরিচর্যা করতেন।
তিনি ছিলেন খাঁটি ধর্মপ্রাণ মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতেন, জিকিরে মগ্ন থাকতেন। দীর্ঘদিন মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি তাহার প্রভুর স্মরণে বিভোর ছিলেন।
আমার কাছে আমার বাবা একজন সত্যিকারের বুজুর্গ, একজন নিখাদ পীর, একজন নিঃস্বার্থ সমাজকর্মী। তাঁর জীবনদর্শন, তাঁর নীতি, তাঁর মানবিকতা আমাদের জন্য অমূল্য শিক্ষার ভাণ্ডার।
আমার বাবা আমাদের কাছে রেখে গেছেন একটাই চাওয়া—আমরা যেন ভাল মানুষ হই, মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করি। আমি সকলের কাছে দোয়া চাই, যেন আমরা তাঁর সেই অনন্ত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি।
মহান আল্লাহ তাআলা যেন আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।
লেখক পরিচিতি:
লায়ন মো. গনি মিয়া বাবুল
চেয়ারম্যান, লেখক উন্নয়ন কেন্দ্র
সভাপতি, কবি সংসদ বাংলাদেশ