সিলেটের হরিপুর, যা এক সময় আলেম-উলামাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো, বর্তমানে চোরাকারবারিদের শাসিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে চোরাই মালামাল ও সিন্ডিকেটের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া এই এলাকায় সেনাবাহিনীর টানা অভিযানের ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে।
গত ক’দিন ধরে সেনাবাহিনী হরিপুরে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালানো হয়েছে, যদিও ঈদ উপলক্ষে অভিযান কিছুটা শিথিল করা হয়েছে, যার ফলে এলাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা ফিরেছে।
২৬শে মার্চ রাতে হরিপুরে একটি চোরাই গরু-মহিষের গাড়ি সেনাবাহিনীর টহলরত গাড়িকে চাপ দেয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, লামা শ্যামপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাড়িটি নিয়ে হরিপুর বাজারের পশুর হাটে এলে, স্থানীয় চোরাকারবারি ও পরিবহন শ্রমিকরা একজোট হয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় এক সেনা কর্মকর্তা ও এক সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন, এবং সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ট্রাক ভাঙচুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এই হামলার নেতৃত্ব দেন হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হেলাল আহমদ ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং স্থানীয় বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যান।
সাঁড়াশি অভিযানে চোরাচালান সিন্ডিকেটে বড় ধাক্কা
হামলার পর সেনাবাহিনী হরিপুরে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদসহ পরিষদের কয়েকজন সদস্যকে সেনা ক্যাম্পে ডেকে এনে চোরাকারবারিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর তাদের নিয়ে অভিযান আরও জোরদার করা হয়।
অভিযানে প্রায় ৩ কোটি টাকার চোরাই পণ্য, যার মধ্যে চিনি ও কসমেটিকস রয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে। তবে চিহ্নিত চোরাকারবারি ও হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
সেনাক্যাম্পে আটক শিকারখাঁ গ্রামের আবুল হাসনাতের ছেলে মো. হাবিবুর রহমান এবং চান্দঘাট এলাকার জহির উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আলী আহমদকে শনিবার বিকেলে জৈন্তাপুর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেনা অভিযানে এখন পর্যন্ত মোট ২৮ জনকে আটক করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গরু-মহিষ চোরাচালানের কেন্দ্র হরিপুর
হরিপুর সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এটি চোরাই পশুর হাট হিসেবে কুখ্যাত। সীমান্ত পেরিয়ে আসা গরু ও মহিষকে এই বাজারে বৈধতা দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। সম্প্রতি হরিপুরের নাম চিনি চোরাচালানেও জড়িয়ে পড়েছে।
সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানে পশুর হাট ও বিভিন্ন গুদাম তল্লাশি করা হচ্ছে। সর্বশেষ রোববার দুপুরে তিন ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে অন্তত ১০০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জ মিত্র চাকমার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা সহায়তা করেছেন।
জৈন্তাপুর থানার ওসি আবুল বাশার মো. বদিউজ্জামান জানান, সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ৭০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের হয়েছে। আটক ৫ জনকে মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সেনাবাহিনীর এই অভিযানের ফলে হরিপুরের চোরাচালান চক্র বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তবে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সেনা অভিযানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।