শাব্বির এলাহী, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার):
এক ভাঙা সাইকেল, দু’আড়াইশো টাকার দৈনিক রোজগার আর অসুস্থ তিন সদস্য নিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ছে ১৪ বছরের কিশোর তোফাজ্জল হোসেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামের আলী আহমদের ছেলে তোফাজ্জলই তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
দিনের শুরুতেই সে বাইসাইকেল নিয়ে পাড়ি দেয় প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের দুর্গম খাসিয়া পুঞ্জিতে। সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। প্রতিদিনের রোজগার দুই থেকে আড়াইশো টাকা। সেই আয়েই চলে অসুস্থ বাবা, মানসিক ভারসাম্যহীন বড় বোন এবং বয়োবৃদ্ধ শয্যাশায়ী দাদীকে নিয়ে তার চার সদস্যের সংসার।
ভাঙা কণ্ঠে তোফাজ্জল জানায়,
“দু’বেলা খাবার জোটানোই কষ্ট। ভাঙা সাইকেল নিয়ে সকালে খাসিয়া পল্লীতে যাই, সন্ধ্যায় ফিরি। আল্লাহ ছাড়া আমাদের দুনিয়ায় কেউ নেই।”
পড়াশোনা? সে তো বহু আগেই বন্ধ। পরিবারের খাবার জোটানোই যেখানে কঠিন, সেখানে শিক্ষা তো অনেক দূরের কথা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সরকারি আবাসন প্রকল্পের ছোট্ট একটি ঘরের মাটির মেঝেতে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আছেন দাদী সমিতা বিবি (৮২)। অপুষ্টি আর ক্ষুধায় কাহিল, কথাও স্পষ্ট বলতে পারেন না। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসে তার। বলেন,
“ঈদের দিন ডালভাত খেয়েছি। ক্ষুধায় রাতে ঘুম হয় না। আল্লাহর রহমতে নাতি যা পারে করছে। কিন্তু ও-ই বা কতটুকু পারবে?”
তোফাজ্জলের বাবা আলী আহমেদ (৬৫) দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন। কোনো কাজ করতে পারেন না। বড় বোন আয়েশা খাতুন (২৫) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন বহুদিন আগে। এই অবস্থায় পুরো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে কিশোর তোফাজ্জল।
প্রতিবেশী ফজল মিয়া বলেন,
“ওদের পরিবারে তিনজনই অসুস্থ। মাঝে মাঝে আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারি সাহায্য করি। খুব কষ্টে আছে ওরা।”
স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক আহমেদ জানান,
“কয়েক বছর আগে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ওদের একটি ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে দূরাবস্থার কথা ছড়িয়ে পড়লে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি সাহায্য করেছেন। তবে এ পরিবারের জন্য টেকসই সহায়তা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা দরকার।”
এমন একটি পরিবারে শিশু তোফাজ্জলের মতো একজন কিশোরের ওপর জীবনযুদ্ধের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজের জন্য এক কঠিন প্রশ্নচিহ্ন। প্রয়োজন এখন শুধুই সাহায্যের হাত নয়, একটি কার্যকর পুনর্বাসন পরিকল্পনা।