গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকায় অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল বিভাগের ১৪টি কারখানা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ায় কারখানার সকল শ্রমিককে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক খাতের ১৬টি কোম্পানির মালিকানা বিক্রি করে দেবে সরকার। এর বাইরে এই গ্রুপসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হবে। চালু থাকবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসসহ শুধু লাভজনক কম্পানিগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত ১১ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ছাঁটাইয়ের ঘোষণা
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, গাজীপুরে অবস্থিত বেক্সিমকো লিমিটেডের (ইয়ার্ন ইউনিট-১ ব্যতিত) ১৪টি কারখানায় কাজের সংকটের কারণে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট সকল শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ছোট-বড়, জানা-অজানা মিলিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের কম্পানির সংখ্যা ১৬৯। এর মধ্যে পোশাক খাতের কোম্পানির সংখ্যা ৩২, যেগুলো উৎপাদনে রয়েছে। এই ৩২টি কম্পানির মধ্যে ১৬টির মালিকানা বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর বাইরে বেক্সিমকো গ্রুপের যেসব প্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে, সেগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের পর বন্ধ করে দেওয়া হবে।
নোটিশে আরও বলা হয়, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের সকল পাওনা আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে এবং এই প্রক্রিয়া ৯ মার্চ থেকে শুরু হবে।
বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির মূল ঋণ নেওয়ার উৎস ছিল জনতা ব্যাংক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির জনতা ব্যাংকের কাছে ২৩,৫৫৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে, যার বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে গেছে। এই ঋণ একক ঋণগ্রহীতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বেক্সিমকোর নতুন করে ঋণ নেওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়।
কোনো ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রাহককে ঋণ না দেওয়ার বিধান রয়েছে ব্যাংক কম্পানি আইনে। কিন্তু এই সীমাকে ৪১০ শতাংশ ছাড়িয়ে আশঙ্কাজনক মাত্রায় ঋণগুলো দেওয়া হয়েছে। আইনের এই লঙ্ঘন সত্ত্বেও সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাইকোর্টে এক রিট শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ১৬টি ব্যাংক ও ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেক্সিমকোর ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের মোট দায় ৫০,০০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ৩২,০০০ কোটি টাকা বর্তমানে খেলাপি। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছিল না, যার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বেক্সিমকোর কাছে জনতা ব্যাংক পাবে ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ (খেলাপি) হিসেবে শ্রেণিকৃত। বাকি প্রায় তিন হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা ওভারডিউ অবস্থায় রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যা মন্দ ঋণে পরিণত হবে।
গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বেক্সিমকোর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ১৬টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার জানায়, অর্ডার সংকট ও ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে কারখানাগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বেক্সিমকোর শ্রমিকদের মাসিক বেতন বাবদ ৬০ কোটি টাকা এবং কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হতো। নিয়মিত বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলেও, এখন পর্যন্ত বড় কোনো আন্দোলন হয়নি।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম জানান, “কারখানা এলাকায় কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।”
বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বেক্সিমকো গ্রুপের এই সংকট দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকার ও ব্যবসায়ী মহল এখন দেখছে, কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় এবং শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হয়।