আনোয়ার শাহজাহান, পাইনআপেল মিউজিয়াম, ঢাকাদক্ষিণ হতে: সিলেটের ঐতিহ্যবাহী উপজেলা গোলাপগঞ্জে এক নীরব কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। একসময় যে জমিগুলো পতিত পড়ে থাকত, সেখানে এখন আনারস বাগান, মাল্টা ও কমলার উদ্যান, কফি ও কাজুবাদামের চাষ, পাশাপাশি মাছ ও গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি প্রবাসীরাও কৃষি খাতে বিনিয়োগ করছেন, যা শুধু ব্যক্তিগত লাভজনক উদ্যোগ নয়, বরং এই অঞ্চলের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করছে। #নতুন_কৃষি_সম্ভাবনার_উন্মোচন সম্প্রতি গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন ফলের বাগান, খামার ও মাছচাষ কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৯৯% কৃষক ও বিনিয়োগকারী তাদের উদ্যোগ থেকে লাভবান হচ্ছেন। অনেকে শত শত একর জমিতে নতুন প্রকল্প শুরু করেছেন বা ভবিষ্যতে শুরু করার পরিকল্পনা করছেন। দত্তরাইল গ্রামে “আব্দুল মতিন চান্দ মিয়া আনারস বাগান” প্রথম বাণিজ্যিকভাবে আনারস চাষ শুরু করে। তখন কেহ ভাবেনি যে আনারস চাষ ব্যবসায়িক সাফল্য আনবে, কিন্তু আজ তার পথ অনুসরণ করে অন্তত ১০-১২টি আনারস বাগান গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে আলভিলা গার্ডেন, পাইনআপেল মিউজিয়াম ও ভাই ভাই আনারস বাগান উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি গোলাপগঞ্জ সরকারী টেকনিক্যাল কলেজ ও গোলাপগঞ্জ স্টেডিয়ামের পাশেই ১ হাজার শতক জায়গায় “লেকভিউ গার্ডেন” নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছের পাশাপাশি মৎস্য খামারও থাকছে।
#প্রাকৃতিক_সম্পদের_সদ্ব্যবহার_ও_কৃষির_নতুন_ধারা: গোলাপগঞ্জের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী, রয়েছে অসংখ্য খাল-বিল, টিলা ও নিচু জমি। একসময় এসব অনাবাদি জমি অব্যবহৃত থাকলেও, বর্তমানে কৃষি উদ্যোক্তারা সেগুলোকে ফলজ বাগান ও খামারে রূপান্তর করছেন। বিশেষ করে পাহাড়ি ও টিলার জমিতে আনারস, মাল্টা, কমলা, কাজুবাদাম ও কফির চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব বাগান শুধু ফল উৎপাদনের কেন্দ্র নয়, বরং কৃষি পর্যটনেরও নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। মানুষ এখন এসব বাগানে ঘুরতে আসছেন, টাটকা ফল খাচ্ছেন এবং সরাসরি বাগান থেকেই কিনে নিচ্ছেন। #মৎস্য_ও_গবাদিপশু_খামারের_উত্থান গোলাপগঞ্জে মাছচাষ দীর্ঘদিন ধরে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এখানে প্রায় দুই শতাধিক মাছের খামার রয়েছে, যেখানে নিচু জমি ব্যবহার করে ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। একইভাবে, গবাদিপশুর খামারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বর্তমানে এখানে শতাধিক গরু ও ছাগলের খামার রয়েছে, যেখানে অনেকে কোটি টাকা মুনাফা করছেন। এছাড়া মুরগির খামারও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং উদ্যোক্তারা প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। স্থানীয় বাজারে এসব ফার্ম থেকে সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় মাংসের চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। #কৃষি_পর্যটনের_বিকাশ গোলাপগঞ্জের পাহাড়-টিলা অঞ্চলে কৃষি পর্যটন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আগে এসব জমি অনাবাদি থাকলেও, গত দুই বছরে দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে গেছে। সারি সারি পাহাড়ে এখন আনারস, কমলা, মাল্টা, লেবু, কাজুবাদাম ও কফির চাষ হচ্ছে। দত্তরাইল গ্রামে পাহাড়-টিলাকে ঘিরে কৃষি পর্যটন গড়ে উঠছে। বেশিরভাগ উদ্যোক্তা প্রবাসী, যারা পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধ বাগান গড়ে তুলেছেন। এখন শুধু আনারস বিক্রি করেই কোনো কোনো চাষি বছরে কোটি টাকা আয় করছেন।
#হলুদ_মরিচ_আদা_ও_পেঁয়াজ_চাষে_সম্ভাবনা গোলাপগঞ্জের কৃষিতে বিপ্লব ঘটলেও, হলুদ, মরিচ, আদা ও পেঁয়াজ চাষে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদার একটি বড় অংশ ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। গোলাপগঞ্জের উর্বর মাটি এসব ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত হলেও, কৃষকদের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকার যদি এই চাষে উৎসাহ প্রদান করে, তাহলে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের আমদানি নির্ভরতা কমবে। #কৃষি_উন্নয়নে_প্রয়োজন_সরকারি_সহযোগিতা গোলাপগঞ্জের কৃষি বিপ্লবকে টেকসই করতে হলে সরকারি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে—
প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা: উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কীটনাশক ব্যবহারের সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে উৎপাদন আরও বাড়বে।
স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা: কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তারা আরও বড় পরিসরে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
সুবিধাজনক বাজার ব্যবস্থা: উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ ও ন্যায্য মূল্যে বিক্রির জন্য উন্নত বাজার ব্যবস্থার প্রয়োজন।
মসলা ও সবজি চাষে উৎসাহ প্রদান: সরকার যদি হলুদ, মরিচ, আদা ও পেঁয়াজ চাষে প্রণোদনা দেয়, তাহলে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের আমদানি নির্ভরতা কমবে।
কৃষি পর্যটনের উন্নয়ন: সরকারি পর্যায়ে কৃষি পর্যটনের জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন হলে এটি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আরও জনপ্রিয় হবে। #গোলাপগঞ্জের_কৃষি_উন্নয়নের_ভবিষ্যৎ গোলাপগঞ্জের কৃষি বিপ্লব যদি সঠিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে এটি শুধু একটি উপজেলার উন্নয়ন নয়, বরং সিলেট তথা পুরো দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠবে। উদ্যোক্তাদের একাগ্রতা, সরকারি সহায়তা এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ একত্রিত হলে গোলাপগঞ্জের কৃষি বিপ্লব আরও বিস্তৃত হবে এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। এই নীরব কৃষি বিপ্লব শুধু গোলাপগঞ্জের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করবে না, বরং সিলেটসহ পুরো দেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এখন প্রয়োজন সরকারি সহায়তা, নীতি সহায়তা ও কৃষকদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করা, যাতে এই বিপ্লব দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আনোয়ার শাহজাহান: সম্পাদক আমাদের প্রতিদিন ও মাসিক লন্ডন বিচিত্রা